Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪,

বালু দিয়ে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ!

বেলাল হোসেন মিলন, বরগুনা

বেলাল হোসেন মিলন, বরগুনা

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০৪:২৮ পিএম


বালু দিয়ে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ!

প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর রক্ষাকবজ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা ঘেষা বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০/২ পোল্ডারের বেড়ীবাঁধটি মাটির বালু দিয়ে নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়ার পাশাপাশি উপকূলে বসবাসরত গণমানুষের মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা।

ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বেড়ীবাঁধ যথাযথ সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধের বেশির ভাগ এলাকা নাজুক হয়ে পড়ে। সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুল, মহাসেন ও আম্ফানের তাণ্ডবে একটা অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়ীবাঁধের কারণে উপকূলীয় এলাকার বেশ কিছু জনপদ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। অনেক এলাকার বসতিরা হারায় সর্বস্ব। চরম ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকে উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রায় পনের লাখ মানুষ। সেই ঝুঁকি মোকাবেলা জন্য উপকূলীয় বেড়ীবাঁধ নির্মাণ প্যাকেজ (সিইআইপি-১) নামে নতুন মেগাপ্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বরগুনা ও পাথরঘাটায় নির্মাণ করা হচ্ছে উপকূলীয় বেড়ীবাঁধ।
  
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৭ সালে ৪০/২ পোল্ডারের ৩৪.২ কিলোমিটার দৈঘ্যের বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেন চায়নার সিকো নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। পাথরঘাটা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ২৪.২ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১৭টি স্লুইসগেট নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।  

এ প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের তেমন নজরদারি না থাকায় ঠিকাদার সংশ্লিষ্টরা মাটির পরিবর্তে বাঁধের পাশ থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে স্লুইসগেটসহ বাঁধ নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছেন। যার ফলে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষাকবজ হিসেবে বিবেচিত পাউবোর বাঁধটির স্থায়িত্ব নিয়ে শংঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলীয় জনগোষ্ঠী।

স্থানীয়রা জানায়, প্রতিটি স্লুইসগেট নির্মাণের পর তা মাটি দিয়ে ভরাট করার কথা থাকলেও তার পরিবর্তে লাখ লাখ সিএফটি নিম্নমানের বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ওই গেইটগুলো ছেড়ে দেয়ার পর তা থেকে পানি নিঃষ্কাশন শুরু হলে ভবিষ্যতে তা লিক করে ভেতরে পানি প্রবেশ করে বালু সরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে স্লুইস গেটগুলো এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসবে না। এছাড়া বাঁধের ওপরের অংশে সামান্য কিছু মাটি দিলেও কোনো ধরনের পরীক্ষা না করেই ময়লা যুক্ত কাঁদাসহ স্যাত স্যাতে মাটি দিয়ে বেড়ীবাঁধে প্রলেপ দিয়ে অনেকটা দায় সারছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাথরঘাটার চরদুয়ানী ইউনিয়নের তাফালবাড়িয়া ও জ্ঞানপাড়ার বাসিন্দারা জানান, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদেরকে ম্যানেজ করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ড্রেজারের মাধ্যমে একটি চক্র বালু লুট করলেও রহস্যজনক কারণে তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।  

চরদুয়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান জুয়েল বলেন, প্রকল্পের শুরুতে বেশ কিছু জায়গায় পুরাতন বেড়ীবাঁধের মাঝখান দিয়ে বিশাল আকারের গর্ত করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বালু দিয়ে ভরাট করে। এ বিষয়ে এলাকার লোকজন নিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ করে দেয়। চরদুয়ানী ইউনিয়নে এক কিলোমিটারের মতো বালু দিয়ে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করায় অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এলাকাবাসী। যে কোন ধরনের দুর্যোগে এই বালু দ্বারা নির্মিত বেড়ীবাঁধ ভেঙে গিয়ে এলাকায় ব্যাপকভাবে প্লাবিত করতে পারে।

প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বালু দেয়ার ব্যাপারে নিষেধ করলে এখন আর বালু দেওয়া হচ্ছে না।

দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংকের কনসাল্টেশন সুপারভিশন ইঞ্জিনিয়ার মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, বেড়ীবাঁধ নির্মাণের বালু ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিকো খামখেয়ালি করে যত্রতত্র গর্ত করে বালু ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে আমি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েছি।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির জানান, বেড়ীবাঁধ নির্মাণে চায়নার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিকো বালু ব্যবহার করছে। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বহুবার অবহিত করেছি। কিন্তু কেহই কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বালু দিয়ে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করা হলে তা হবে আমাদের জন্য একটা মরণ ফাঁদ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এই বেড়ীবাঁধের উপর আঘাত করলে তাৎক্ষণিকভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। নিঃস্ব হয়ে যাবে এই সাগর উপকূলীয় জনপদ।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমিও জেনেছি। এ ব্যাপারে আমিও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিতভাবে অবহিত করব। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকির কোন সুযোগ রাখা হয়নি।

এ ব্যাপারে বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট লোকদেরকে ডেকে আমি সিডিউল দেখব, তারপরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেব।

কেএস 

Link copied!