Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

রানির রেল সেলুন সৈয়দপুরে

১৯২৭ সালে তৈরি বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট সেলুন’

সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি

সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২, ০৪:২৯ পিএম


১৯২৭ সালে তৈরি বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট সেলুন’

নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপে সংরক্ষিত রাখা আছে ১২৬৫নং কোচ। এটি একটি ট্রেন কোচ। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের ভারতবর্ষ ভ্রমণের জন্য ১৯২৭ সালে তৈরি করা হয় বিলাসবহুল এই কোচ। যা প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ নামে পরিচিত।

ওই সপে কোচটির কিছু জিনিস মেরামত করে সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের জন্য নেওয়া হবে কারখানায় নবনির্মিত জাদুঘরে। নতুন প্রজন্মের কাছে  ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এখনো সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি। যার ভেতরে লালগালিচায় মোড়ানো কাঠের ছয়টি কামরা। চমৎকার রং আর বৈচিত্র্যপূর্ণ নকশা সেই কাঠজুড়ে।

আছে শয়ন কক্ষ, বিলাসবহুল বাথরুম, বেসিন, শাওয়ার, লাইট, ফ্যান, সুইচ বোর্ড। একটি কনফারেন্স রুম। ঠিক যেন রাজপ্রাসাদ। কিন্তু না এটি কোনো রাজপ্রাসাদ নয়, বরং রাজপ্রাসাদের আদলে তৈরি ঐতিহাসিক রেল কোচ। ব্রিটিশ আমলের এই নিদর্শনটি এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ।
সরেজমিনে কারখানার ক্যারেজ শপে গিয়ে দেখা মেলে কালের সাক্ষী এবং রেলওয়ের ঐতিহ্যের স্মারক প্রেসিডেন্ট সেলুনটির। কোচটির ভেতরে প্রবেশ করে মনে হয় এটি কোনো আধুনিক বাসভবন।

প্রবেশদ্বারেই রয়েছে কোচটির ইতিহাস সংবলিত একটি ওয়ালবোর্ড। এক পা এগুতেই চোখে পড়ে একটি কামরা। এটি নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। রয়েছে রানির সঙ্গে আগত পাইক-পেয়াদা ও তার স্টাফদের জন্য থাকার আলাদা কক্ষ।

এরপরে দেখা মেলে একটি সভাকক্ষের। এটি অন্যগুলোর তুলনায় বেশ বড়। বড় দুটি সোফা রাখা আছে সেখানে, সেই সোফার সামনে আছে ৮ থেকে ১০টি চেয়ার। যার সব কটিই সেগুন কাঠের তৈরি। নান্দনিক কারুকার্য দেয়ালজুড়ে।

লালগালিচা আর সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো পুরো কনফারেন্স রুম। সেখানে কক্ষের সঙ্গে লাগানো আলমারিতে আছে ডিংকস্ কেস, মদের বোতল রাখার তাক, আছে সিগারেটের ছাইদানি। রয়েছে এসি, নান্দনিক ডিজাইনের লাইটিং, ফ্যান, উন্নত কাঠের ফার্নিচার আর দামি ঝাড়বাতি।

সভাকক্ষ পেরিয়ে সামনে এগুতেই চোখে পড়ে দুই বিছানার একটি বেড রুম। এটি রানির জন্য বরাদ্দ ছিল। সেখানে আছে খাট, ফোল্ডিং বেসিন। দোতলা আলমারি, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার জন্য তামার তৈরি ছোট ছোট দুটি পাত্র, ঝাড়বাতি। এরপর এক কক্ষজুড়ে বাথরুম। পুরো কক্ষটিই যেন পাঁচ তারকা হোটেলের আদলে গড়া।

পুরো দেয়াল উন্নতমানের ছোট ছোট টাইলসে বাঁধানো, সিমেন্ট বা বালু দিয়ে না, স্ক্রু দিয়ে আটকানো প্রতিটি টাইলস। সিলিংও সবুজাভ টাইলস মোড়ানো। মেঝেতে কাঠের ওপর মোজাইক। আছে সেই আমলের উন্নত হাই কমোড, সেখানকার ঝাড়বাতিগুলোও নকশা করা ও রঙিন।

দেয়ালজুড়ে তামা-পিতলের আলপনা। সাবান-শ্যাম্পু আর ব্রাশ রাখার জন্য আছে তামার তৈরি নান্দনিক ঝুড়ি, যাতে গৌরবময় আভিজাত্য ফুটে ওঠে। সেই ওয়াশরুমে আছে বিশাল সবুজ মার্বেলের বাথটাব, আছে পিতলের ঝরনা।

এরপরের কামরাটি বাবুর্চিদের থাকার জন্য। সেখানেও রয়েছে কাঠের দুটি খাট। এর পরের কক্ষটি রান্নাঘর। বাইরে থেকেও বোঝার উপায় নেই এই কোচের ভেতরের অবস্থা। লাইটগুলো অচল হওয়ায় আলোর জন্য নতুন করে লাইট স্থাপন করা হয়েছে।

ছয় কামরাবিশিষ্ট এই কোচের প্রতিটি কক্ষেই আছে কাঠের তৈরি কারুকার্যখচিত খাট, কাপড় রাখার আলমারি, নান্দনিক ডিজাইনের লাইটিং, ফ্যান, এসি ও দামি ফার্নিচার। পুরো কোচ লাল মখমলের কার্পেটিং করা।

প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে একটি করে অ্যাটাচ বাথরুম ও বেলজিয়ামের উন্নত স্যানিটারি ফিটিংস। বোঝাই যায় না, এগুলো শত বছর আগের তৈরি। ব্রিটিশ আমলের এসব আসবাব বর্তমান সময়ের আধুনিকতাকেও হার মানায়। সাধারণ কোচে ৮টি চাকা থাকলেও সেলুনটিতে রয়েছে ১২টি চাকা।

রেলওয়ে কারখানা সূত্রমতে, এটি ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ নির্মিত বিশেষায়িত একটি কোচ। দেশভাগের পর ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান রেলওয়েকে এই সেলুন কোচটি উপহার হিসেবে দিয়ে যায়। এরপর থেকে এটি শুধু মাত্র রাষ্ট্রপতির জন্য সংরক্ষিত থাকায় এর নাম হয় রেলওয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন।

দেশের প্রেসিডেন্টদের ট্রেন ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। তখন এটিকে রাষ্ট্রপতি সেলুন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনিই একমাত্র এই সেলুন ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮১ সালে কোচটি অনুপোযোগী হয়ে পড়লে মেরামতের জন্য আনা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায়।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান বলেন, সর্বপ্রথম রাণী এলিজাবেথ এই সেলুনে কোচে ভ্রমণ করেন। পরবর্তীকালে এটা পরিবর্তিত হয়ে প্রেসিডেন্ট সেলুন কোচ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে এটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে মেরামতের জন্য সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় আনা হয়। বর্তমানে ব্যবহার না হলেও, আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে রেখে দিয়েছি এটি। যাতে আগামী প্রজন্ম এর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে।

কারখানার কর্মব্যবস্থাপক (ডাব্লিউ এম) শেখ হাসানুজ্জামান বলেন, বর্তমানে সেলুন কোচটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ শপে থাকলেও কিছু জিনিস মেরামত করে দর্শনার্থীদের জন্য নবনির্মিত সৈয়দপুর রেলওয়ে জাদুঘরে নেওয়া হবে।

এসএম

Link copied!