Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

মানবতার ফেরিওয়ালা প্রতিবন্ধী হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী

বাগাতিপাড়া (নাটোর) প্রতিনিধি

বাগাতিপাড়া (নাটোর) প্রতিনিধি

অক্টোবর ৩০, ২০২২, ০২:২৫ পিএম


মানবতার ফেরিওয়ালা প্রতিবন্ধী হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী

মানবতার ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত নাটোর জেলা প্রশাসক‍‍`র কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রতিবন্ধী হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী। নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের চক আমহাটি গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঐ গ্রামেই বসবাস করেন তিনি।

জানা যায়, তিনি যা বেতন পান তাই দিয়েই টেনে কোষে চলে তার সংসার। সৎ ও সচেতন মানুষ হিসেবে নিজ এলাকা ও কর্মস্থানে সুনাম রয়েছে তার। হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী নিজ উদ্যোগে প্রতিবছর এলাকার একজন ছিন্নমূল মানুষকে ঘর তৈরি করে দেন। প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার উপরে একটি ঘর নির্মাণ কাজে প্রয়োজন হয়। আর এই অর্থ যোগান দেন তিনি আর তার নিজের এলাকার বিত্তবান এবং জেলা প্রশাসন‘র বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বিগত চার বছরে ৪টি পরিবারের মাথা গোজার ঠাঁই ও একজন প্রতিবন্ধীকে কর্মসংস্থান তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।

পাটোয়ারী বলছেন, তার বেতনের টাকা থেকে কিছু টাকা আর এলাকাবাসী এবং তার অফিসের সকলেই কম বেশি সহযোগিতার টাকা ব্যয় হয় অসহায় মানুষের পরিবারের জন্য।

উপকার-ভোগীরা বলছেন, নিজের উপার্জিত অর্থে এই ঘর নির্মাণ করা তাদের দ্বারা সম্ভব ছিল না। প্রশাসন বলছেন, উদ্যোগী এই মানুষকে সরকারি ভাবে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। এমন মানুষ সমাজের দৃষ্টান্ত হলে মনে করছেন নাটোরের সচেতন মহল।

উপকারভোগী প্রতিবন্ধী শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ইটভাটায় কাজ করতাম। দুর্ঘটনায় আমার একটি হাত সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয়েছে। সেই সময় চিকিৎসার জন্য হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী অনেক স্থান থেকে টাকা সংগ্রহ করে আমার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার থাকার কোন ঘর ছিল না। আমার পৈতৃক সম্পত্তির উপর বাড়ি বানিয়ে, টিউবল বসিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে একটি দোকান তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি সবসময় আমার খোঁজ খবর রাখেন। এখন আমি খুব ভালো আছি। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন। আমার মতন আরো মানুষদেরকে তিনি সহযোগিতা করতে পারেন।’

এছাড়া আরও ৩জন উপকারভোগী বলেন, আমাদের ঘরের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়তো। টিন দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারীর উসিলায় আমরা নতুন টিন সেটের ঘর পেয়েছি, টিউবল পেয়েছি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছি। এছাড়াও আমরা যে কোন বিষয়ে তার সহযোগিতা পাই।

আওয়ামী যুবলীগ নেতা ও ইট ভাটা মালিক মোঃ জামিল হোসেন মিলন বলেন, হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারীকে নিয়ে গ্রামবাসীরা গর্ববোধ করে। সামান্য একটি সরকারি চাকরি করে তিনি যে অসহায় মানুষদের কথা ভাবেন তা আমাদেরকে অভিভূত করে। তার কাজে আমরা গ্রামবাসী সকলেই সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছি। ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করা হবে।

হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, প্রথমত ২০১৯ সালে এক বৃদ্ধ নারী আমাকে বলেন- আমার থাকার মতো কোন ঘর নেই। আপনি ডিসি অফিসে চাকুরী করেন আমাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তখন আমি জেলা প্রশাসক মহোদয় বরাবর একটি আবেদন করি। টিনের বরাদ্দ দেন মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়। এলাকাবাসীরা সার্বিকভাবে সহযোগিতায় বৃদ্ধা নারীকে একটি ঘর করে দিই প্রথম। এরপর থেকে প্রতিবছর, গ্রামের একজনকে বসতবাড়ি তৈরি করে দেওয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত মোট চারজনকে টিউবলসহ ঘর ও একজন কে একটি দোকান করে দিয়েছি। এই কাজে আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শাহ রিয়াজ স্যার সহ এলাকাবাসী, আমার ডিসি অফিস, ৭টি উপজেলার সকল সহকর্মী, কর্মকর্তাগণ।

নাটোর ইউনাইটেড প্রেসক্লাবের সভাপতি রেজাউল করিম রেজা বলেন, ‘চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী, নিজের কর্মস্থান ও সংসার সামলিয়ে, নিজ উদ্যোগে এলাকাবাসী ও প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং নিজের অর্জিত অর্থ দিয়ে, যাদের ঘরবাড়ি তৈরি করার সামর্থ্য নেই, তাদেরকে বাড়িঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। সামাজিক উন্নয়নে যে কর্মকান্ড গুলো তিনি করছেন, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসনীয়। আমি মনে করি এটি একটি মহতী উদ্যোগ। আমাদের সমাজে এমন কিছু প্রচার বিমুখ মানুষ লুকিয়ে আছেন, তারা নিরলস ভাবে মানুষের উপকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এ ধরনের মানুষ আমাদের সমাজে আছে বলেই সমাজ এগিয়ে চলছে।

তিনি আরো বলেন, হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারীর একটি দৃষ্টান্ত। প্রতিবন্ধী হয়েও সমাজ উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এই দৃষ্টান্তকে অনুকরণ করে অন্যরাও যদি এগিয়ে আসে, তাহলে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর দুঃখ দুর্দশা দ্রুত লাঘব হবে।  

জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী এলাকাবাসীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যে সহযোগিতা করছেন, এটা খুবই একটা ভালো দিক। যে কোন ক্ষেত্রে আমরা সরকারের দিকে চেয়ে থাকি। সরকারিভাবে প্রত্যেকটা বিষয়ে হয়তো সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না। এলাকাবাসীর সহযোগিতার জন্য তিনি যে এগিয়ে এসেছেন। এমন ব্যক্তি উদ্যোগ অমাদের দেশের সবখানে থাকা দরকার। তাহলে আমরা খুব সহজেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব।’

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, হাবিবুল্লাহ পাটোয়ারী সমাজের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের সকলের জন্য। চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী হয়েও অসহায়, নিরীহ, নিরন্ন মানুষের জন্য তিনি যেভাবে কাজ করছেন। কারো ঘর করে দিচ্ছেন। কারো চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন করছেন। কারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিচ্ছেন।

জেলা প্রশাসক আরো বলেন, এ বিষয়টি আমাদের সকলকে অনুপ্রেরণা যোগায়। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে তাকে উৎসাহ দিচ্ছি, পাশাপাশি তার এই কাজে জেলা প্রশাসন অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। আগামী দিনগুলোতে আমি আশা করি, তিনি আরো সৃজনশীল এবং জনহিতকর কাজ করবেন এবং সেই কাজের সাথে আমাদের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী অবশ্যই অংশীদার হবেন।

আমাদের সমাজে একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠী রয়েছে। যে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা একদিকে যেমন কমছে, অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে, তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। এই হাবিবুল্লা পাটোয়ারী অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্তকে অনুকরণ করবেন সমাজের বৃত্তবানরা, এমনটাই মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

কেএস 

Link copied!