বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ডিসেম্বর ৩, ২০২২, ০১:১১ পিএম
বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ডিসেম্বর ৩, ২০২২, ০১:১১ পিএম
আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়। ১৯৯২ সন থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা ও তাদের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ৩১তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২৪তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
২০২২ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য, `অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমূখী পদক্ষেপ: প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা`। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সকল স্তরের কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধীদের সমান অংশগ্রহণ এবং উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে তাদের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিতকরণ। প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুসারে আমাদের দেশের প্রায় ৮-১০% মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার স্বীকার। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের সাথে জাতীয় উন্নয়নের যোগসূত্র রয়েছে।
ফিরে যাওয়া যাক সদ্য এসএসসি পাস করা বাকপ্রতিবন্ধী তুষারের গল্পে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগরে জন্মগ্রহণ করা বাকপ্রতিবন্ধী তুষার ইমরান চৌধুরী ৪ বোন ১ ভাইয়ের মাঝে সবার বড়। বাবা কলেজ শিক্ষক আর মা মাছুমা ইয়াছমিন একজন গৃহিণী। তুষার ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় চম্পকনগর মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৩.১৭ পেয়ে পাস করেছেন। বোবা ছেলের এমন সাফল্যে পুরো এলাকায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই ভীষণ খুশি। বিদ্যালয়ের চলতি দায়িত্বে থাকা সহকারি প্রধান শিক্ষক জনাব কামাল স্যার খুবই উচ্ছ্বসিত। নিজের ছাত্র সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, `৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করেছে। শিক্ষক এবং সহপাঠীরা সবসময় সহযোগিতা করেছে তাকে। বাকপ্রতিবন্ধী হয়েও সে অন্যদের মতোই ভালো রেজাল্ট করেছে। এটা নিশ্চয় তার নিজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ অর্জন হয়ে থাকবে`।
তুষারের বাবা চম্পকনগর উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী কলেজের সহকারি অধ্যাপক জনাব লুৎফর রহমান (লিটন) ছেলের সফলতায় আবেগাপ্লুত; তিনি বলেন, এই পর্যন্ত আসতে আমাকে এবং তার মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ধৈর্য্যের প্রতিবিম্ব হয়ে দিন-রাত তার পিছনে শ্রম দিতে হয়েছে। মনের দিক থেকে কখনো দুর্বল হইনি।
ছেলের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ছোট সময়ে সে একবার রাস্তায় মারাত্মকভাবে এক্সিডেন্ট করে। হাঁটুর নিচের অংশ একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সুস্থ হবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। আল্লাহর উপর ভরসা করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি স্কুলের শিক্ষক এবং তার সহপাঠীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তুষারের মা মাছুমা ইয়াছমিন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, তাকে অক্ষর চিনাতেই আমাদের ১ বছর সময় লেগেছে। ১০ জনের শ্রম একজনকে দিতে হয়েছে। তবু বাবা-মা হিসেবে আমরা কখনো হাল ছাড়িনি। আমাদের কষ্ট স্বার্থক হয়েছে। আজ আমরা অনেক খুশি।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায় প্রথমে বাড়ির নিকটবর্তী ইকরা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। প্রাথমিক সমাপনীতে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে পাশ করে। অল্পের জন্য এ প্লাস থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর চম্পকনগর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। ৮ম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হওয়া জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫৬ পেয়ে পাশ করে। সর্বশেষ একই প্রতিষ্ঠানে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে ৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সনে এই বিদ্যালয় থেকেই তুষারের এক বোন তাশবিহ্ চৌধুরী তুশিবা এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে সাধারণ গ্রেডে বোর্ড স্কলারশিপসহ জিপিএ ৫ পেয়ে পাশ করেছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় মূক- বধিরদের জন্য একটিমাত্র স্কুল রয়েছে। ১৯৪২ সনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূক ও বধির নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলটি জেলার পৌর শহরের পশ্চিম পাইকপাড়ায় অবস্থিত।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব মো. তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, স্কুলে ভর্তি হয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো বাকপ্রতিবন্ধী এসসএসসি পাশ করেছে তা আমার জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূক ও বধির স্কুলে প্রায় দুই যুগ ধরে আছি। ২০১০ সাল থেকে এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসতেছি। আমাদের মূক-বধির স্কুলে লেখাপড়া করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়সহ অন্য স্কুল থেকে জেএসসি পাশ করেছে এমন কিছু ছাত্র রয়েছে। এই সংখ্যা খুবই অল্প। স্নাতক করেছেন এমনও আছে। তবে প্রথম শ্রেণি থেকে একনাগারে আর দশজন স্বাভাবিক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে পড়েনি কেও। তুষারকে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মূক-বধির প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। আমরা অচিরেই তার বিষয়ে খোঁজখবর নিব। বোবাদের আমি দীর্ঘদিন যাবৎ খুব কাছ থেকে দেখে আসছি। এটি একজন বাকপ্রতিবন্ধী ছেলের জন্য অনেক বড় অর্জন। আমি তুষারের বাবা-মা এবং শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানাই।
তুষার অবশ্য ৪র্থ শ্রেণিতে কয়েকমাস মূক-বধির স্কুলে পড়েছিলেন। স্কুলের পাশে অবস্থিত এখানকার কলেজের গভর্নিং বডি`র সদস্য (বিদ্যোৎসাহী) মো. আ. খালেক বলেন, একজন বোবা মানুষ সবার সাথে পরীক্ষা দিয়ে যে ফলাফল করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী চম্পকনগর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে উৎসাহিত করতে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দেন। চলাফেরায় অত্যন্ত স্মার্ট সুশ্রী তুষার সম্পর্কে এলাকাবাসী জানায়, এই বয়সে যথেষ্ট ধার্মিক। আযান হলেই মসজিদে চলে যায় এবং নিয়মিত নামায আদায় করে। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিগত জ্ঞানে খুব পিছিয়ে নেই সে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ সক্রিয়। Tushar Imran Chowdhury নামের একটি ফেসবুক আইডি রয়েছে তার। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে ভার্চুয়াল যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।
এ সম্পর্কে বিজয়নগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার জনাব আ.জলিল মুঠোফোনে প্রতিবেদককে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ বিষয়। উচ্চ শিক্ষার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সবরকম সহযোগিতা করা হবে। আমি তার উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।
সুস্থ, স্বাভাবিক ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে অনেকসময় বাবা-মাকে বেশ বেগ পেতে হয়, ব্যর্থ হতে হয়। শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার বা উন্নয়নে কথা বলতে না পারা একজন বাকপ্রতিবন্ধী তুষার আর তার পিতা-মাতা হতে পারে অনন্য উদাহরণ।
কেএস