নেত্রকোনা প্রতিনিধি
ডিসেম্বর ৫, ২০২২, ০৫:৪৩ পিএম
নেত্রকোনা প্রতিনিধি
ডিসেম্বর ৫, ২০২২, ০৫:৪৩ পিএম
নেত্রকোনায় হাওরাঞ্চলে ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ১০ মাস আগে। এখন পর্যন্ত অর্ধেক বিলও পাননি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কমিটির লোকজন। এতে এ কাজের সংশ্লিষ্টরা খুবই হতাশার মধ্যে রয়েছেন। তাদের অনেকে সুদের টাকায় কাজ করিয়েছেন। সুদের টাকা বেড়ে হয়েছে কয়েকগুণ। কেউ আবার জমি বিক্রি করে মাটি ভরাট কাজের লরি-ভ্যাকু ও শ্রমিকের বিল পরিশোধ করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা বা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষায় ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে জেলায় ১০ উপজেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার হাওরে ১৬৬টি ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণ করা হয়। ২৩ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ১৮৩ কিলোমিটার ডুবন্ত বাধ নির্মাণ করা হয়। সেই লক্ষে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন করা হয়। ডিসেম্বরে কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। স্থানীয় কৃষকদের সমন্বয়ে এসব পিআইসি গঠন করা হয়।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার পিআইসির সভাপতিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাজ শুরুর আগেই পিআইসি পেতে পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনকে কাজের ৩০-৪০ শতাংশ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ১০ মাস আগে বাধ নির্মাণ কাজ শেষ হলেও বিল এখনো বাকি রয়েছে। কোন উপজেলায় ৩০ শতাংশ, আর কোথাও ৫০ শতাংশ বিল পেয়েছেন এই সময়ে। অথচ কাজের শ্রমিক ও লরি-ভ্যাকুর বিল তারা জমি বিক্রি করে বা সুদে এনে পরিশোধ করেছেন। সঠিক সময়ে বিল না পাওয়ায় তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর ইউনিয়নের ডিঙাপোতা হাওরের পাশে চিকাডুবি খাল এলাকার ফসল রক্ষা বাধ প্রকল্পের সভাপতি আবুল কালাম বলেন, আমার দেড় কিলোমিটার দৈঘ্যের বাধটি নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ২৫ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত মাত্র আট লাখ টাকা বিল পেয়েছি। বিল না পেয়ে কাজের ভ্যাকু-লরির ভাড়া নিজের জমি বন্ধক দিয়ে পরিশোধ করেছি। নিজের জমি আছে এই হাওরে তাই নিজের ও এলাকার কৃষকের স্বার্থে বাধ নির্মাণের কাজ নেই। আমাদের উপজেলায় বাধের কাজের বিল কেউই ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি কেউ পায়নি। অনেকে জমি বিক্রি করে ভ্যাকু-লরির বিল পরিশোধ করেছে। অনেকে সুদে টাকা এনে ইনভেস্ট করে পথে বসে গেছে।
মোহনগঞ্জের গাগলাজুর উপজেলার করাচাপুর এলাকায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘের একটি ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণের কাজ করেন মো. আ. হান্নান। তিনি বলেন, ২৫ লাখ টাকার বাধ নির্মাণে কাজ করেছি। ১০ মাস গত হলো এ পর্যন্ত ৭-৮ লাখ টাকা পেয়েছি।
মদন উপজেলার পাদারকোনা সুইচ গেট হতে নয়াপাড়া ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত ফসল রক্ষা বাঁধের সভাপতি আব্দুল মজিদ জানান, ১৪ লাখ টাকার একটু বেশি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করেছি। কাজ শেষ হয়েছে ১০ মাস আগে। এখন পর্যন্ত বিল পেয়েছি মোট বিলের ৬০ শতাংশ। ৪০ শতাংশ বিল এখনো বাকি। ইতিমধ্যে নতুন করে ফসল রক্ষা বাঁধের জন্য মিটি গঠন করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, কাজ পেতে গিয়ে পাউবো, ইউএনও অফিসসহ নানা জায়গায় ৪০ শতাংশের বেশি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এরপর লাভ বলে আর কিছু থাকে না। তরপরও বছর ধরে বিল বাকি। উল্টো লোকশানে আছি। অনেকে সুদে টাকা এনেও বাধের কাজে লাগিয়েছে। বিল পায়নি ১০ মাসেও। এতদিনে সুদের টাকা বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। কিন্তু পুরো বিল এখনো আমারা পাইনি। শুধু আমার নয়, সবারই একই অবস্থা। বাধের বিল কেউ পুরোপুরি পায়নি।
কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, বিল আসেনি। একদিকে কাজের বিল পাই না ঠিক মতো। অন্যদিকে পানির সময় বাধ ভাঙার টেনশনে ঘুমানো যায় না। বাধের কাজে লাভ কোন লাভ নেই। গত বছরও বাধের কাছে লোকশান হয়েছে। এরআগের বছরও লোকশান হয়েছে। তাই এবার আর বাধের কাজের জন্য আবেদন করিনি।
মদন উপজেলার পাদারকোনা সুইচ গেইট থেকে দাউদপুর পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাধের বরাদ্দ ধরা হয় ২১ লাখ টাকা।
এ প্রকল্পের সভাপতি আবুল হাসান বলেন, যথাযথ বাধ দেওয়ার পরও বরাদ্দের বিল ৩০ শতাংশ বিল কেটে নেয়। এতে ভ্যাট টেক্স বাদে ১৮ লাখ টাকার মতো পাওয়ার কথা। কাজ শেষ হয়েছে গত বর্ষার আগে (ফেব্রæয়ারিতে) এরমধ্যে পেয়েছি মাত্র ১১ লাখ টাকা। বাকি টাকা কবে পাব জানি না। অথচ প্রকল্প পেতে প্রথমেই কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় ৪০ শতাংশের বেশি টাকা ঘুষ নগদে হাত থেকে দিয়ে দিতে হয়। লাভ তো দূরের কথা ফসল রক্ষা বাধ প্রকল্পে আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ৩-৪ বছর আগে একবার এই বাধের কাজে লোকশান গুনতে গিয়ে এক একর জমি বিক্রি করেছি। এই কথা এলাকার সবাই জানে।
কলমাকান্দার উপজেলার বড়কাপন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাদিছুজ্জামান হাদিছ বলেন, আমি এবার একটি বাধের কাজ করেছি। ১৫ লাখ টাকার কাজের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকার মতো পেয়েছি। বাকি টাকা কবে পাব জানি না। এরমধ্যে নতুন করে বাধ নির্মাণের জন্য পিআইসি গঠন করা হচ্ছে। এবার আর কোন পিআইসি নেব না। আর লোকশানে পড়তে চাই না।
নেত্রকোনা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সোমবার বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যথা সময়ে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তাই প্রকল্পের পুরো বিল দেওয়া যায়নি। আমরা যতটুকু বরাদ্দ পেয়েছি ততটুকু পরিশোধ করেছি। আশা করছি চলতি ডিম্বেরের মধ্যে সমস্ত বিল পরিশোধ করতে পারবো।
কেএস