Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

শহীদ বীরবিক্রম সিরাজুলের বীরত্বের কথা

আশরাফুল ইসলাম তুষার ও শাহেদ আলী

আশরাফুল ইসলাম তুষার ও শাহেদ আলী

ডিসেম্বর ১৫, ২০২২, ০৪:০৫ পিএম


শহীদ বীরবিক্রম সিরাজুলের বীরত্বের কথা

বিজয়ের  মাস আসলেই মনে পড়ে ১৯৭১ সনের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। তৎকালীন সময় কিশোরগঞ্জ মহকুমা ৩নং সেক্টরের অধীনস্থ হলেও ২নং, ৩নং, ৪নং, ৫নং এবং ১১নং সেক্টরে ট্রেনিং প্রাপ্ত কিশোরগঞ্জ জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধাই বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করে পাক বাহিনীর দখলকৃত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করেছে। বিশেষ করে বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চলের থানা গুলোকে মুক্ত করতে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান রয়েছে।

৫নং সেক্টরের অধীন বড়ছড়া সাব সেক্টরটির নাম দিয়ছিল ব্রসাটম্ব। অধিনায়ক ছিলন প্রথম ক্যাপ্টেন মুসলিম, এর পূর্বে এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার গুজাদিয়া গ্রামর কৃতি সন্তান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমান ভূঞা।

এই সেক্টরের এক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলাম (বীর বিক্রম)। তার গ্রামের বাড়ী ইটনা উপজেলার এলংজুরী ইউপির অজপাড়া ছিলনী গ্রাম। তার পিতার নাম মাক্তুল হাসন। মাতার নাম গফুরুন্নেছা।

১৯৭১ সনের ৮ আগস্ট সুনামগঞ্জ জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাচনা বাজার পাক হানাদার মুক্ত করার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং শহীদ হন। স্বাধীনতা উত্তর সরকার শহীদ সিরাজের বীরত্ব ও আত্মদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করেন। মৃত্যুর আগে তিনি ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে টেকের ঘাট হইতে তার পিতার কাছে গ্রামের ঠিকানায় অত্যন্ত গোপনে একটি চিঠি পাঠিয়ে দেন।

“চিঠির অনুলিপি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হল” এলাহী ভরসা টেকের ঘাট হইতে তাং-৩০/০৭/৭১ইং প্রিয় আব্বাজান, আমার সালাম নিবেন আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ীর সকলের কাছে আমার সালাম ও স্নেহ রহিল। বর্তমানে যুদ্ধে আছি, আলী রাজা, রওশন রনু, ছাত্তার, ইব্রাহিম, ফুল মিয়া, সকলেই একত্র আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি।কারণ দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্য থাকবেনা। তাই যুদ্ধকে জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিবো না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার সালাম দিবেন। বড় ভাইকে চাকুরী যেতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখ আছি। যেকোন সময় মৃত্যু হতে পার এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়।তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে। পুত্র হারা বাবা বলে ডাকবে।এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন আর আমার জন্য দোয়া, চিন্তার কোন কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন।তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে। “দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর, মিরজাফরী করিওনা। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের ক্ষমা করবে না। এই বাংলায় তোমাদের জায়গা হবে না।সালাম দেশবাসী ইতি‍‍` মো: সিরাজুল ইসলাম‍‍`।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজের বাবা মায়ের সাথে দেখা করলে সিরাজের সহযোদ্ধাকে এই চিঠিটা তারা বের করে দেন। পরবর্তীতে এই চিঠিটি বড়ছড়া সাব সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মুসলিম ছদ্মনাম মেজর দ্বীন ভিন এবং ক্যাপ্টেন রমজান নামও পরিচিত ছিলেন। তার হাতে এনে তুলে দেন ক্যাপ্টেন মুসলিম শহীদ সিরাজের স্বহস্তে লিখিত চিঠি খানি খুবই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিলেন। এর প্রমাণ মিলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ গ্রন্থ লেখক মেজর জেনারেল কে. এস সফিউল্লা (বীর উত্তম) এর লেখা থেকে।

কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল মহাবিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় শহীদ সিরাজ মাও: ভাসানী সমর্থিত পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ফলে বি.এ অধ্যয়ন কালে তিনি ঐ সংগঠনের পক্ষ থেকে কলেজ সংসদ নির্বাচনে ভি.পি পদ প্রার্থী হয়েছিলেন। একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে তিনি ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। নিজের একক চেষ্টায় অবহেলিত ও অনুন্নত গ্রামে তিনি একটি পল্লী উন্নয়ন সমিতি গড়ে তুলেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সিরাজ মেঘালয় ইকায়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ৫ম ব্যাচের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ইস্টার্ন কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল জগজিৎ সিং অকাবার শুভাশিসকে নিয়ে তিনি ৫নং সেক্টরে একটি চৌকস কোম্পানি গড়ে তুলেন এবং এর নেতৃত্ব দেন।শহীদ সিরাজ পিতা মাতার একমাত্র পুত্র ছিলন। 
১৯৭১ সালর ৮ আগস্ট ২৭ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতে সাচনা বাজার নদী বন্দর এলাকাটি পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে গিয়ে সিরাজুল ইসলামের ডান চোখের নীচে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন। সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক শোক প্রস্তাবে সাচনার নাম সিরাজনগর করা হয়। 
শহীদ সিরাজুল ইসলাম ভাটি বাংলার গর্ব। হাওর এলাকার মাতম ধনী হায় সিরাজ হায় সিরাজ। সিরাজের এক ছোট বোন মনোয়ারা বেচে আছে, তাছাড়া তার আর কেউ বেচে নেই।সালাম লও শহীদ সিরাজুল ইসলাম (বীর বিক্রম)।

এসএম

Link copied!