নওগাঁ প্রতিনিধি
জানুয়ারি ২০, ২০২৩, ০৪:৪৬ পিএম
নওগাঁ প্রতিনিধি
জানুয়ারি ২০, ২০২৩, ০৪:৪৬ পিএম
নওগাঁর ধামইরহাটে সর্ববৃহৎ ও সুপ্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানকে পাখিদের অভয়ারণ্য বলা হলেও বন বিভাগের উদাসিনতায় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে দীঘির পরিবেশ।
দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় লতা পাতায় দূষিত হয়ে পড়েছে দিঘির পানি ও চারপাশ। এতে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ আলতাদীঘির পরিবেশ। হুমকিতে রয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। সরেজমিনে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়।
প্রতিবছর শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আলতাদিঘীর জলে দাপিয়ে বেড়াতো পরিযায়ী পাখিরা। অথিথি পাখিদের মধ্যে রাজ সরালি, পাতি সরালি, বালি হাঁস, রাজহাঁস, মান্দারিন হাঁস, গোলাপি রাজহাঁস, ঝুটি হাঁস, চকাচকি, চিনা হাঁস, কালো হাঁস, লালশীর, নীল শির, মানিকজোড়, জল পিপি, ডুবুরি, হারিয়াল গাংচিল উলেখযোগ্য হলেও চলতি বছর তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
জনশ্রুতি রয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে একসময় প্রবল খরার কারণে মাঠ-ঘাট সব পুড়ছিল চরম পানীয় সংকটে। প্রজাদের দাবির কারণে স্থানীয় জগদল বিহারের (১০৭৭-১১২০ খ্রিষ্টাব্দে) রাজা রামপাল ও সদর পালের রাজ্য শাসনের সময় রাজমাতা পুত্রের কাছে বর চাইলেন। ওয়াদা করিয়ে নেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠে আমি যতদূর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পারব, ততদূর পর্যন্ত একটি দিঘি খনন করে দিতে হবে। মায়ের কথায় বৃদ্ধ মা হেঁটে চলেছেন তো চলেছেন আর থামেন না। রাজা, উজির, নাজির পড়লেন বেকায়দায়। এত লম্বা দিঘি খনন করবেন কী করে? তাই কৌশলে মায়ের পায়ে আলতা ঢেলে দিয়ে পা কেটে গেছে বলে তার চলার পথ বন্ধ করে দেন। সেই থেকে এই দিঘির নামকরণ করা হয় আলতাদিঘি।
অন্যদিকে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান সংস্কার ও উন্নয়নের কথা বলে দীঘির দুই পাড় থেকে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলায় দিঘির পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে পড়েছে ঠিক তেমনি হুমকির মুখে পড়েছে পরিয়ায়ী পাখিরা।
স্থানীয় ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীত মৌসুমের শুরুতে কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে দিঘির পানিতে কলকাকলিতে মেতে উঠতো অতিথি পাখিরা। বর্তমানে গভীরতা কমে যাওয়ার সঙ্গে লতা পাতা পড়ে পানি দূষিত হওয়ায় এর পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসা পাখিদের উপস্থিতি কম লক্ষ্য করা গেছে। যে পাখিগুলো এসেছে সেগুলো দিঘির বিষাক্ত পানিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে না। এমন অবস্থায় দীঘি খননসহ পঁচা পানি সংস্কার করা না হলে আগামীতে পাখিদের বিচরণ কমে যাবে এমনটিই জানিয়েছেন তারা।
উপজেলা বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান রাজশাহী সামাজিক বনবিভাগের আওতায় নওগাঁ সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দুরে ধামইরহাট উপজেলায় পাইকবান্দা রেঞ্জের অধীনে ধামইরহাট বিটে অবস্থিত।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় ২০১১ সালে ১৪ ডিসেম্বর ‘আলতাদিঘীকে জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর মোট আয়তন ২৬৪.১২ হেক্টর। বনভূমির মাঝখানে ৪৩ একর আয়তনে গড়ে উঠেছে এক বিশাল দিঘী। জাতীয় উদ্যানের পাশে ১৭.৩৪ হেক্টর বনভূমিকে ২০১৬ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন।
জয়পুরহাট থেকে হাবিবুর রহমান পরিবার নিয়ে আলতাদীঘি দেখতে আসেন। দীঘির দূষিত পানি ও দুই পাড় থেকে অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা দেখে বিস্মিত হয়েছেন তিনি। শুধুমাত্র পাখি দেখার জন্য প্রতি বছর এখানে আসি। তবে আজ কি দেখছি?
তিনি আরো বলেন, প্রকৃতির নিসর্গ আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানে দায়িত্বশীলদের উদাসীনতায় পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। এতে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমে গেছে বলে তিনি জানান।
নওগাঁর রাণীনগর থেকে আসা অপর দর্শনার্থী আবু সুফিয়ান জানান, এর আগে দিঘীর পরিবেশ অনেক সুন্দর ছিল। দিঘির বুকে পদ্ম ফুলের আড়ালে খেলা করতো পাখিরা। দিঘির বিবর্ণ দূষিত পানি দেখে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বগুড়া থেকে অপর দর্শনার্থী ছাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ফেসবুকে আলতাদিঘীর দুই পাশে অনেক গাছ ও দিঘীর আকাশে ঝাঁক বেঁধে দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছিলেন পরিযায়ী পাখিদের। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দিঘির পঁচা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে নামমাত্র পরিযায়ী পাখিরা। এমন চলতে থাকলে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান থেকে অতিথি পাখিদের কোলাহল থেমে যাবে।
উপজেলা বন বিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ‘উর্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি পেলে দীঘির খনন কাজ শুরু করা হবে। দীঘির দুই পাড়ের গাছগুলো পুরনো হওয়ায় কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে শোভা বর্ধনকারী গাছ লাগানো হবে। আবহাওয়ার কারণে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা অনেক সময় আপডাউন করলেও পাখিদের সংখ্যা বেড়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ বলেন, যেহেতু আলতাদিঘী সংরক্ষিত অঞ্চল। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় লতা পাতা পড়ে দূষিত হয়ে পড়েছে দিঘির পানি ও এর চারপাশ।
যার কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। দিঘিটি সংস্কার করতে হবে এমনভাবে সেখানকার মাছ, উদ্ভিদ, কচুরিপানা, কিছুই সরানো যাবে না। জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিযায়ী পাখির নিরাপদ আবাস্থল এটি। সংস্কারের নামে পরিযায়ী পাখিদের বিতাড়িত করা যাবে না।
তিনি আরোও বলেন, আলতাদিঘীতে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পাখির এই আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে হবে। সুপ্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ আলতাদীঘির পরিবেশ এবং পরিযায়ী পাখি রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকেও এগিয়ে আসতে হবে বলেও জানান তিনি।
এআরএস