Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মঠবাড়িয়া কুঠিবাড়ি

মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) প্রতিনিধি

মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) প্রতিনিধি

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩, ০৪:৫২ পিএম


রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে মঠবাড়িয়া কুঠিবাড়ি

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে সাপলেজা ইউনিয়নে বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মিত কুঠিবাড়ি প্রাসাদ। যেন প্রতিটা ইটে লুকিয়ে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। আনুমানিক আঠারো শতকের গোড়ায় জনৈক ইংরেজ জমিদার এডওয়ার্ড প্যারি ক্যাসপার এ কুঠিবাড়ি নির্মাণ করেন। সোয়া ৯ একর জমির উপর নির্মিত হয় ক্যাসপারের কুঠিবাড়ি।

কথিত আছে মি. ক্যাসপার ঘটনাক্রমে সাপলেজা ভ্রমণকালে স্থানীয় ধর্নঢ্য ফরাজউল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করতে উক্ত জমি উপহার দেন। পরবর্তীকালে এখানে ক্যাসপারের জমিদারি সম্প্রসারিত হয়। প্যারি ক্যাসপারের উপস্থিতিতে প্রতিবছর পৌষ মাসের শেষভাগে কুঠিবাড়িতে পুণ্যাহ উৎসব উপলক্ষে খাজনা আদায়সহ প্রজাদের মনোরঞ্জনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

এর মধ্যে যাদু প্রদর্শনী, লোকগান, যাত্রা ও নিমাই সন্ন্যাস পালায় প্রচুর লোক সমাগম হতো। কুঠিবাড়ির মূলভবন নির্মাণে প্রচালিত ধারার বৃটিশ স্থাপত্যরীতিতে চৌকোণাকৃতির ১৮টি খিলানের উপর দোতলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা ও বড় একটি পুকুর। কুঠিবাড়ির উপরের তলায় প্যারি ক্যাসপারের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত মূল্যবান সামগ্রী ও তৈজসপত্র ছিল।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর বৃটিশরা চলে গেলে ভবন ও সম্পত্তি তখনকার সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ক্যাসপার সাহেব চলে যাবার আগে সাপলেজা এলাকার গ্রামের নাম তার পিতা শিলার সাহেবের নামে নামকরণ করে যান। নায়েব, পাইক পেয়াদাদের থাকার জন্য নির্মাণ করেন আরো একটি ভবন।

দ্বিতল ভবনটির নীচের তলায় অফিস কক্ষে বসে এলাকার খাজনা আদায় ও বিচার পরিচালনা করতেন। পরে অজ্ঞাত কারণে ভেঙে দেয়া হয় মূল ভবনটির দোতলার সম্পূর্ণ অংশ। সুন্দরবন সংলগ্ন সাপলেজা কুঠিবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এওয়ার্ড পেরি কাসপার এই প্রকার পত্তনি প্রহণ করা একজন কুটিয়াল বা জমিদার। কুটিয়াল কাসপার এখানে কখোনও বসবাস না করে, তার অতি বিশ্বস্ত কর্মচারি সুরেশ চন্দ্র সুর এবং সতীশ চন্দ্রের মাধ্যমে জমিদারি পরিচালনা করতো বলে জানা যায়।

ফসল তোলা শেষ হলে জমিদার কাসপার নির্দিষ্ট দিনে খাজনা সংগ্রহ করে চলে যেত। প্রতিদিন এই কুঠিবাড়িতে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। তবে এখানে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তাসহ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এখনও গড়ে উঠেনি। পর্যটকদের বিশ্রাম ও থাকার জন্য তেমন সুযোগ-সুবিধাও ছিলোনা। তখন এ অংশে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল বেহাত হয়ে যায়। লিখিত আকারে এই ভবনের বিস্তারিত ইতিহাস না পাওয়ায় জমিদার এডওয়ার্ড প্যারি ক্যাসপার ও তাঁর জমিদারী বিষয়, ব্যক্তিগত জীবন, ভবনের নির্মাণশৈলী ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন জানা যায়নি।

ধারণা করা হয় বৃটিশ আর্কাইভ বা কোন প্রকাশনায় কুঠিবাড়ির তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ক্যাসপারের ব্যবহৃত যে দুটি তরবারিসহ কিছু তৈজসপত্র ছিল তাও এখন নিখোঁজ। বর্তমানে কুঠিবাড়িটি দু’শ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শানবাঁধানো ঘাটসহ পুকুর জৌলুশহীন। কুঠিবাড়ির তৎকালীন ম্যানেজার সুরেন্দ নাথ সুর ও নায়েব সতীশ চন্দ্রর কোনো বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায় না। এডওয়ার্ড পেরি ক্যাসপারের একটি বড় বোট ছিল। এ বোটে করেই তিনি শীত মৌসুমে তৎকালীন চন্দ্রদীপ (বর্তমান বরিশাল) থেকে কুঠিবাড়ি আসতেন। এলাকার খাজনা আদায় করে আবার শীত শেষে চলে যেতেন। যেহেতু তিনি শীত মৌসুমে এখানে অবস্থান করতেন তাই ভবনটিকে গরম রাখার জন্য বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। মূল ভবনের নীচে চারকোণে কয়লার আগুন রাখার ব্যবস্থা ছিল। তাতে পুরো বাড়ি গরম থাকতো।

প্রথমে ক্যাসপার সাহেবের মূল বাড়ি সংস্কার করে ও পরিবর্তন করে ইউনিয়ন ভূমি অফিস (তহসীল অফিস) হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একই জমিতে অন্য স্থানে নতুন ভূমি অফিস ভবন নির্মিত হওয়ায় ক্যাসপারের বাড়িটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। তবে স্থানীয় ডাকঘরটি ক্যাসপারের পিতা শিলার সাহেবের নামে এখনও শিলারগঞ্জ নামে পরিচিত। প্রাসাদটি সংরক্ষণের অভাবে অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সঠিক সংস্কার করলে বহু বছর টিকে থাকবে প্রাসাদটি।

স্থানীয়রা জানান, সরকার কঠিবাড়ির মালিকানা নিলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ভালো উদ্যোগ নেয়নি। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রত্নসম্পদ সাপলেজা কুঠিবাড়ি। বর্তমানে কুঠিবাড়ির তিনটি ভবন  জরুরি সংস্কার করা না হলে মূল ভবনটিসহ সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জামাল/এআরএস

Link copied!