নজরুল ইসলাম মুকুল, কুষ্টিয়া
ডিসেম্বর ১০, ২০২৩, ১২:২৭ পিএম
নজরুল ইসলাম মুকুল, কুষ্টিয়া
ডিসেম্বর ১০, ২০২৩, ১২:২৭ পিএম
আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে কুষ্টিয়া জেলার বীরমুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহযোগীতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করে কুষ্টিয়াকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করেছিল।
জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যে কারণেই কুষ্টিয়া জেলাতে ছোট বড় ১২৭টি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ যুদ্ধ তিনটি, বৃহৎযুদ্ধ দুটি। বাকিগুলো ছোট ছোট যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ জেলার ইপিআর, পুলিশ, আনছার, ছাত্র-জনতা কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইন, ওয়ারলেস অফিস, জেলা স্কুল, থানা প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানীকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে। এ সময় জেলার সাধারণ মানুষ সড়কী, বল্লভ, রামদা, লাঠিশোঠা দিয়ে বেশ কিছু পাকহানাদার বাহিনীকে হত্যা করে। সে কারণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট’র ডি কোম্পানীর বিলুপ্তি ঘটে। ৩১ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম কুষ্টিয়া শত্রু মুক্ত হয়।
কুষ্টিয়া জেলা শত্রু মুক্ত থাকার কারণে জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ জেলাতে আসেন এবং তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার বৈদ্যনাথ তলায় মুজিবনগর সরকার গঠন ও শপথ নিতে পারেন।
কুষ্টিয়া জেলা ১৬ দিন শত্রুমুক্ত থাকার পর পুনরায় পাকহানাদার বাহিনী ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া শহর দখল করে নেয় এবং ব্যাপক গুলি বর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। আগষ্ট- সেপ্টেম্বর মাসের দিকে পাকহানাদার বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের কারণে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়া শহর ছাড়া সমস্ত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তারপরই বাংলাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
মুক্তিমিত্র যৌথ বাহিনীর আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনী পর্যুদস্থ হতে থাকে। ৮ ও ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর সম্পূর্ণরুপে শক্রমুক্ত হয়। যৌথ বাহিনী ঝিনাইদহ মহকুমা দখল করে একটি গ্রুপ কুষ্টিয়া অভিমুখে রওনা হয়।
অন্য একটি গ্রুপ চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা পোড়াদহ হয়ে শহরের সন্নিকটে এসে উপস্থিত হয়। কুষ্টিয়াকে মুক্ত করতে যেখানেই শত্রু সেখানে যুদ্ধ করে চলে মুক্তিযোদ্ধারা। কুষ্টিয়া শহরকেও শত্রুমুক্ত করতে শহরকে অবরোধ করে রাখে। এমতাবস্থায় পাকহানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অতি গোপনে কুষ্টিয়া শহরের দক্ষিণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কের চৌড়হাসে বিটিসির নিকট জিকে ক্যানেলের ব্রিজের উত্তর পাশে ক্যামফ্লাশ করে এ্যামবুশ বা ফাঁদ পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর সঠিক অবস্থানের তথ্য না নিয়ে কয়েক শত সৈন্য, ভারী অস্ত্র, ট্যাংক, মেশিন গান, কামানসহ ভারতীয় ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে আটিলারী কেভারী গ্রুপ কুষ্টিয়া শহর অভিমুখে রওনা হলে পাকহানাদার বাহিনী ফায়ার ওপেন করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। শুরু হয় তুমুল আকারে যুদ্ধ। নিহত হয় কয়েক শত সৈন্য। এ সময় যৌথ বাহিনীর কয়েকটি ট্যাংক, কামানসহ ভারী অস্ত্র ও একটি বিমান ধবংস হয়ে যায়।
বাঙালির বীরদর্পে যুদ্ধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী কুষ্টিয়া শহর ছেড়ে পালিয়ে ভেড়ামারা হয়ে হাডিঞ্জ ব্রিজ অভিমুখে রওনা হয়। সেখানে বাঙালির হাতে অনেক পাকবাহিনী নিহত হয়। বিমান থেকে বোম্বিং ও গুলি বর্ষণ করে কুষ্টিয়ার হাডিঞ্জ ব্রিজের দুটি স্প্যান ভেঙে ফেলে। কুষ্টিয়াবাসীর বীরদর্পে যুদ্ধের ফলে পাকহানাদার বাহিনী অনেকেই নিহত হয়, অনেকেই পালিয়ে যায়। বহু ত্যাগ আর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে, বহু মা বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়া শহরসহ সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা শত্রুমুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর।
এআরএস