Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪,

নওগাঁ-৩ আসন

ট্রাক-ঈগল ঠেকাতে মরিয়া নৌকার কর্মীরা

কাজী সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ)

কাজী সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ)

জানুয়ারি ৪, ২০২৪, ১২:৫৭ পিএম


ট্রাক-ঈগল ঠেকাতে মরিয়া নৌকার কর্মীরা
নওগাঁর মহাদেবপুর নির্বাচনি সহিংসতায় আহত তিন কর্মী রফিকুল ইসলাম, মাসুদ বিল্লাহ ও বরকতুল্লাহ। ছবি: আমার সংবাদ

নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনে মোট সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পেয়েছেন নতুন মুখ সদ্য অবসর পাওয়া সাবেক সিনিয়র সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন। বর্তমান এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম এবার নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, লড়ছেন ট্রাক প্রতীক নিয়ে। তিনি ২০১৪ সালে কলস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে তখনকার আওয়ামী লীগের এমপি ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি তখন মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে নৌকা প্রতীক দেয়া হলে আবার তিনি নির্বাচিত হন।

প্রয়াত ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী মাহফুজা আকরাম মায়া চৌধুরীও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, লড়ছেন ঈগল প্রতীক নিয়ে। আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ডি এম মাহবুব উল মান্নাফ শুভ লড়ছেন কাচি প্রতীক নিয়ে। এছাড়াও ভোটের মাঠে আছেন জাতীয় পার্টির মাসুদ রানা, তৃণমূল বিএনপির সোহেল কবীর চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কৌতুক অভিনেতা শামীনুর রহমান চিকন আলী।

এই আসনে নৌকার নতুন মাঝি সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন সচিব থাকাকালে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করে এলাকার মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েই তিনি মহাদেবপুর-বদলগাছী এলাকায় গণসংযোগে নেমে পড়েন। তফসিল ঘোষণার আগে পর্যন্ত তিনি এই দুই উপজেলার কিছু আওয়ামী লীগ নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়ান। সেসময় এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের সঙ্গে যাদের বনিবনা হয়নি, তাদের নিয়েই সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী মাঠে নামেন। এদের মধ্যে ছিলেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত মহাদেবপুর সদর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহামন ধলু, মনোনয়ন বঞ্চিত রাইগাঁ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম মঞ্জু, মনোনয়ন বঞ্চিত খাজুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম, সফাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন পেয়েও জিততে না পারা অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।

তবে সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন নৌকার মনোনয় পাবার পর এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিমও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় তার পাল্লাই ভারি হয়েছে বেশি। তার সঙ্গে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জেলা পরিষদ সদস্য গোলাম নুরানী আলাল, সহ-সভাপতি সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদিউজ্জামান বদি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাবুল চন্দ্র ঘোষ বাবু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাফিজুল হক বকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মন্ডল, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক গোলাম রেজাউন্নবী আনসারী বাবু, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তনু কুমার দেব প্রমুখ। পক্ষান্তরে সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেনের পক্ষ নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান আহসান হাবীব ভোদন, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অজিত কুমার মন্ডল, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শ্রী অনুকুল চন্দ্র সাহা বুদু, যুব মহিলা লীগের নেত্রী উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া রহমান পলি, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মুছা আল আশআরী প্রমুখ।

সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর সমর্থকেরা মনে করেছিলেন নৌকা প্রতীক পেলে সহজেই জয়লাভ করতে পারবেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতায় সে আশায় গুড়ে বালি পড়েছে তাদের। সতন্ত্র প্রার্থী রাখার দলীয় সিদ্ধান্তে দ্বিধায় পড়ে যান। ক্রমে নির্বাচনী প্রচারণা জমে উঠলে আরো বেকায়দায় পড়ে যান। একে নতুন প্রার্থী, তার উপর আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী তিনজন। এদেরকে নিয়ে রীতিমত শংকায় পড়ে যান তারা। প্রথম দিকে স্বতন্ত্র ঠেকাতে হুমকি ধামকির পথ বেছে নেন তারা। গত ১৬ ডিসেম্বর বদলগাছীতে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম খান প্রকাশ্যে মাইকে বক্তব্য দেয়ার সময় এই এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট চাইতে গেলে তাদেরকে মেরে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। এছাড়া মহাদেবপুর খাজুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বর্ধিত সভায় বক্তব্য দানকালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও খাজুর ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন আত্রাই নদীর পশ্চিম পাড়ের খাজুর, হাতুড় ও চাঁন্দাশ ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোন অফিস করতে দেয়া হবেনা বলে ঘোষণা দেন। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরপরই মহাদেবপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম এবং তার দুই ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকি ও রাকিবকে গালিগালাজ, তাঁর ট্রাক মার্কার নির্বাচনী অফিস ভাংচুর, কর্মীদের পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। ওইরাতে উপজেলার ছয়টি স্থানে কর্মীদের নানান হুমকি দেয়া হয়।

উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়নের মাতাজীহাটে তার নির্বাচনী অফিস উদ্বোধনের সময় প্রতিপক্ষরা সেখানে হামলা চালায়। তারা এমপি সেলিমকে গালিগালাজ করতে থাকে এবং কয়েকজন কর্মীকে লাথি মারতে থাকে। তারা এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোন অফিস হবেনা বলে ঘোষণা দিয়ে হুমকি দিতে থাকে। রাত ৮টায় এমপির ছেলে যুবলীগ নেতা সাকলাইন মাহমুদ রকি উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের খোর্দকালনা গ্রামে নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন করতে গেলে নৌকার সমর্থকেরা বাধা দেয়। এই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোন অফিস হবে না বলে হুমকি দিতে থাকে। বিষয়টি মহাদেবপুর থানা পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। কিন্তু পুলিশ চলে যাবার পরই নৌকার কর্মীরা হামলা চালিয়ে অফিসটি ভেঙ্গে ফেলে। তারা লাঠি, লোহার রড প্রভৃতি নিয়ে হামলা চালায়। এতে রকি লাঞ্ছিত হয়। এছাড়া ১০ জন কর্মী আহত হয়। মারাত্মক আহত চারজনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করানো হয়। লোহার রডের আঘাতে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক জখম হয়। এদের মধ্যে মাসুদ বিল্লাহ নামে একজনের মাথায় মারাত্মক জখম হয়েছে ও তার ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। তার অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের নওহাটা মোড়ে, সফাপুর ইউনিয়নের ঈশ্বের লক্ষ্মীপুর গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মারপিট করা হয়েছে। এছাড়া খাজুর ইউনিয়নের কুঞ্জবন গ্রামের একজন হিন্দু কর্মীকে, চাঁন্দাশ ইউনিয়নের লাউয়াডাঙ্গ গ্রামের দুজন হিন্দু কর্মীকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের সাগরইল গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের উপর লাঠিসোঠা দিয়ে হামলা করায় রফিকুল ইসলাম ও বরকতুল্লাহ নামে দুজন কর্মী মারাত্মক আহত হন। এসব ব্যাপারে থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সব ঘটনায় প্রতিপক্ষরা নৌকার কর্মীদেরও মারপিট ও অফিস ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে অফিস পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর খোর্দকালনা গ্রামে নৌকার অফিস ভাঙচুর, ২০ ডিসেম্বর রাতে ঝলঝলি মোড়ে নৌকার অফিসে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। উভয়পক্ষই পাল্টাপাল্টি মামলায় কোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন।

তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সহিংসতা কমেছে। নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মহাদেবপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রিফাত আরা জানান, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গ্রামে গ্রামে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের অসংখ্য নির্বাচনী অফিস থাকায় কর্মীদের মধ্যে বচসা লেগেই থাকতো। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে একটি করে অফিস রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। গত তিন দিনে বিজিবিসহ অভিযান চালিয়ে তিনি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৪০টির বেশি অননুমোদিত নির্বাচনি অফিস ঘর বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে নির্বাচনি সহিংসতা কমেছে।

এআরএস

Link copied!