Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

সীমিত সামর্থ্যে সেবায় অনন্য করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

মো. আব্দুল জলিল, করিমগঞ্জ (কিশোরগঞ্জ)

মো. আব্দুল জলিল, করিমগঞ্জ (কিশোরগঞ্জ)

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪, ০৪:২২ পিএম


সীমিত সামর্থ্যে সেবায় অনন্য করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা ও নানা সংকট নিয়ে চলছিল হাসপাতালটি। এখন আমূল পাল্টে যাচ্ছে সব।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির ভেতরে-বাইরে এমনভাবে সাজানো-গোছানো, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ফলে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের রোগ যেমন সারে তেমন মনও জুড়ায়।

বছর দুয়েক আগেও হাসপাতাল চত্বরের খোলা জায়গাটি অবহেলায় পড়ে ছিল। ময়লা–আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। হাসপাতালের ভেতরটাও ছিল নোংরা। এখন চারদিক সবুজে ঘেরা। প্রধান ফটকে ঢুকতেই ফুলের বাগান। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুল। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে বাইরে ঝকঝকে পরিবেশ। বারান্দার টবে নানা প্রজাতির গাছ। ভেতরে ঢুকতেই জরুরি বিভাগ। পরিপাটি বিশ্রামাগার। দেয়ালে টানানো পরীক্ষা নিরীক্ষার মূল্যতালিকা। হাসপাতালটিতে সেবা নিতে এসেও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট।

হাসপাতালটির বদলে যাওয়ার নেপথ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রিয়াদ শাহেদ রনি। পরিবেশগত উন্নয়ন ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য ভূমিকা রাখছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে সেবার ক্ষেত্রে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত দূরে।

সরেজমিনে রবিবার সকালে প্রধান ফটক দিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই সবুজে ছাওয়া চত্বর চোখ জুড়িয়ে যায়। জরুরি বিভাগের সামনেই ফুলের বাগান। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুল। অপেক্ষমাণ কক্ষটি পরিপাটি। চিকিৎসা নিতে আসা অনেকে চিকিৎসকের সাক্ষাতের জন্য বসে আছেন। কেউ টিকিট কিনছেন। জরুরি বিভাগের পাশে নিজের কক্ষে বসে সিসিটিভি ক্যামেরার দৃশ্য মনিটরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রিয়াদ শাহেদ রনি।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানালেন, দিনে কয়েকবার করে পরিষ্কার করেন তারা।

পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন করিমগঞ্জের গুজাদিয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের মানিক মিয়া বলেন, পেটব্যথা নিয়ে দুদিন আগে ভর্তি হয়েছেন। ভালো সেবা পাচ্ছেন। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। খাবারের মানও ভালো। ডাকলে নার্সরাও আসেন। দুই বছর আগেও এই হাসপাতালে এসেছিলেন মানিক মিয়া। তখন এমন সেবা পাননি তিনি।

আগের চেয়ে হাসপাতালের পরিবেশ অনেক বদলে গেছে বলে জানালেন উপজেলার গুনধর ইউনিয়নের ইন্দা-চুল্লী চন্দিয়া গ্রামের বুদু মিয়া (৮০)। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে এখন আর বিড়াল দেখা যায় না।

মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একই উপজেলার পৌর এলাকার নাগেরনাথ বিশ্বাস (৭০) বলেন, শৌচাগার ও ওয়ার্ডের ভেতর নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। আগে এমনটা ছিল না।

করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে কথা হয় কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলায় তেরটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এর মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। আগে যেসব সমস্যা ছিল, তা এখন নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে রোগীর উপস্থিতি ও সেবার মান বেড়েছে। সেখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রিয়াদ শাহেদ রনির প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে বর্তমানে ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, ডেন্টাল ইউনিট, স্বাভাবিক প্রসব, প্যাথলজি, ফার্মেসি, করোনা টেস্ট ও করোনার টিকা, গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য এএনসি কর্নার ও ইপিআই বা টিকাদান কর্মসূচি সেবা চালু রয়েছে। গত এক বছরে শতাধিক নারীকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করানো হয়েছে। চালু রয়েছে ব্রেস্ট ফিডিং ব্যবস্থা ও পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আইএমসিআই (ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেস) সেবা।

ডা. রিয়াদ শাহেদ রনি ২০২০ সালের শুরুতে করিমগঞ্জ উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি এর আগেও এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকাকালে এ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি লক্ষ্য করেন। তখন থেকেই করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেকে একটি মডেল কমপ্লেক্সে হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন জাগে তার মধ্যে।

পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বদলি হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই এ কমপ্লেক্সকে মডেল কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেন। এরপর মাত্র তিন বছরে কমপ্লেক্সের চিত্র অনেকখানি পাল্টে দিয়েছেন।

২০০১ সালে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩৩ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। প্রতিদিন সেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অস্ত্রোপচারকক্ষ আছে। আগে অস্ত্রোপচার হতো না। গতবছর মার্চ থেকে অর্থোপেডিক্সের ছোটখাটো অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। শিগগির প্রসূতি অস্ত্রোপচারও শুরু হবে।

আগে ডেন্টাল চিকিৎসক ও ডেন্টাল ইউনিটের চিকিৎসাসামগ্রী ছিল না। এখন ডেন্টাল চিকিৎসকও আছেন, চিকিৎসাসামগ্রীও আছে।
বর্তমানে উপজেলা পরিষদের সহযোগিতায় ডেন্টাল ইউনিটের চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে নিয়মিত মুখ ও দাঁতের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালটির সেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হান্নান মোল্লা আমার সংবাদকে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি উপজেলার প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল। এখানে দীর্ঘদিন নানা অব্যবস্থাপনা ছিল। ডা. রিয়াদ শাহেদ রনির প্রচেষ্টায় এখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আগের ও বর্তমানের চিকিৎসাসেবা তুলনা করতে গিয়ে করিমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. পিয়াল হাসান বলেন, দুই বছর আগে প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১৫০ থেকে ২০০ জন চিকিৎসা নিতেন। আর অন্তর্বিভাগে ২৫ থেকে ৩০ জন ভর্তি থাকতেন। এখন রোজ বহির্বিভাগে ৮০০ থেকে সহস্রাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। আর অন্তর্বিভাগে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০০১ সালে কমপ্লেক্সটি ৩৩ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। কমপ্লেক্সটি দুটি ব্লকে বিভক্ত। এখানে চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল দরকার ১১৭ জন। এর মধ্যে বর্তমানে রয়েছেন ৭৩ জন। বাকি ৪৪টি পদ শূন্য। চিকিৎসকের ৩২টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। চিকিৎসকের শূন্য পদের মধ্যে ৫ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ৭ জন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা (ইউনানি)। বর্তমানে ১৫ জন চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে ৩ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট রয়েছেন। আর ৪ জন চিকিৎসক ডেপোটেশনে রয়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রিয়াদ শাহেদ রনি আমার সংবাদকে বলেন, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নেই। যা আছে, তাই দিয়েই আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য এ কমপ্লেক্সকে একটি মডেল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করা, যাতে প্রত্যান্তঞ্চলসহ এলাকার মানুষ হাতের কাছেই স্বাস্থ্যসেবা পান।

ইএইচ

Link copied!