Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ঘোড়াঘাটের এলএসডি গুদাম

পৌনে ২ কোটি টাকার চাল নিয়ে উধাও খাদ্য কর্মকর্তা, কী বলছে দুদক

ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:

ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:

মে ১১, ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম


পৌনে ২ কোটি টাকার চাল নিয়ে উধাও খাদ্য কর্মকর্তা, কী বলছে দুদক

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ডুগডুগিহাট এলএসডি গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম (৫৪)। আর মাত্র দু‘মাস পরেই অবসরে যাবেন খাদ্য বিভাগের এই কর্মকর্তা। এরই মধ্যে হঠাৎ আত্মগোপনে আনোয়ারা। তার ব্যবহৃত মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ছুটি না নিয়ে কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকায় তার গ্রামের ঠিকানায় একাধিকবার নোটিশ পাঠায় উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়।

অভিযোগ উঠে গুদামে থাকা সরকারি চাল আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়েছে তিনি। এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা খাদ্যে নিয়ন্ত্রক।

দিনাজপুর জেলার সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহন আহম্মেদের নেতৃত্বে গত ২রা মে খাদ্য গুদামে উপস্থিত হন ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভাঙ্গা হয় গুদামের তালা। খুলতে থাকে রহস্যের জট! সরকারি খাদ্য গুদামের দুটি কক্ষে মজুদ থাকা চাল গুণতে সময় লাগে দুই কার্য দিবস।

গত ৬ মে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে চোখ কপালে উঠার মত তথ্য! সরকারি গুদামের ১ কোটি ৭১ লক্ষ ২৭৯ টাকার চাল ও পাটের বস্তা চলে গেছে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগমের পেটে।

গুদামের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করার পর সাড়িবদ্ধ ভাবে খামাল দেওয়া শস্যের মজুদ দেখতে পান তদন্ত কমিটি। তবে গণনার জন্য লেবারের মাধ্যমে বস্তা সরাতে থাকলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। প্রতিটি খামালের চারপাশে চাল ভর্তি বস্তা ঠিক থাকলেও মাঝখান ছিল একবারে ফাঁকা। যা দেখতে চালের বস্তার পাড় বেঁধে পুকুর তৈরির মত!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত আনোয়ারা বেগম (৫৪) পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার নুনিয়াগাড়ী গ্রামের আব্দুল
মতিন মন্ডলের স্ত্রী। তিনি গত ৫ বছর যাবত ডুগডুগিহাট এলএসডি গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার চাকরির মেয়াদ আছে আর মাত্র ২ মাস। এরপরেই তিনি অবসরে যেতেন বলে নিশ্চিত করেছেন ঘোড়াঘাট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইউনূছ আলী। গত ২৫ এপ্রিল থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আনোয়ারা।

তদন্ত কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গুদামে ৩১ হাজার ৫১৮ বস্তায় ১০৬৪ মেট্রিক টন ১৫৫ কেজি চাল থাকার কথা। তবে গুদামে ২১ হাজার ৫১৮ বস্তায় ৭৪৫ মেট্রিক টন ০১৪ কেজি চালের মজুদ পাওয়া যায়। গুদাম থেকে লাপাত্তা ১০ হাজার ৬৬ বস্তা চাল। এসব বস্তায় চাল ছিল ৩১৯ মেট্রিক টন ১৪১ কেজি। যার বাজারমূল্য ১ কোটি ৬৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৫৯ টাকা। এছাড়াও গুদামে ৫০ কেজি ওজনের খালি চটের বস্তার ঘাটতি রয়েছে ৪ হাজার ২৭৮টি। প্রতিটি ৯০ টাকা হারে যার বাজার মূল্যে ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার ২০ টাকা।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে চাল আত্মসাতের ঘটনায় আনোয়ারা বেগম সহ আরো দুজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন, গুদামের নিরাপত্তা প্রহরী মফিজুল ইসলাম (৩২) এবং লেবারের সর্দার শাহিনুর আলম (৩৫)। এ ঘটনায় ৭ মে রাতে ঘোড়াঘাট থানায় অভিযুক্ত আনোয়ারা বেগম সহ ৩  জনের বিরুদ্ধে এজাহার জমা দিয়েছেন ঘোড়াঘাট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইউনূছ আলী মন্ডল।

এজাহারে বলা হয়, গত ১৫ এপ্রিল গুদামে সরেজমিন পাক্ষিক পরিদর্শনে গেলে শষ্য মজুদের তারতম্য দেখতে পান খাদ্য নিয়ন্ত্রক। গত ৪ মার্চ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে যেকোনো সময় অভিযুক্ত তিনজন পরিকল্পিত ভাবে চাল আত্মসাৎ করে। এই ঘটনার পর গত ৮ মে অভিযুক্ত গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম এবং নিরাপত্তা প্রহরী মফিজুল ইসলাম (৩২) কে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেছে খাদ্য বিভাগ। অভিযুক্ত লেবারের সর্দার শাহিনুর ও নিরাপত্তা প্রহরী মফিজুলও নিজেদের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন।

এত টাকার চাল লোপাট হলো কি করে?

দেশের সকল এলএসডি গুদামে মাসে দু‘বার পরিদর্শন হয়। পাক্ষিক পরিদর্শনে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গুদামের রেজিষ্টার যাচাই পূর্বক গুদামে মজুদ থাকা শস্য মিলিয়ে দেখেন।

ঘোড়াঘাট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইউনূছ আলী মন্ডলের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) থেকে জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল বেলা ১১টায় তিনি ডুগডুগিহাট খাদ্য গুদামে পাক্ষিক পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনে গুদামে থাকা শস্য মজুদে তারতম্য পরিলক্ষিত হয় তার। তবে তার আগের পরিদর্শনে সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। অর্থাৎ মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম গুদাম থেকে ৩১৯ মেট্রিক টন ১৪১ কেজি চাল গায়েব করেছেন!

প্রশ্ন জাগে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে এত অল্প সময়ে এতগুলো চাল গায়েব হলো কিভাবে? সরাসরি গুদাম থেকে চাল সরানো হলে তা দীর্ঘ সময় নিয়ে ট্রাকে লোড করে তারপর বাহিরে নিয়ে যেতে হয়েছে।

উপজেলার অন্য একটি গুদামে কর্মরত এক কর্মচারী নিজের নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, বরাদ্দ অনুযায়ী কাগজে কলমে চাল কিনলেও, প্রকৃত অর্থে লোপাট হওয়া চাল গুদামে প্রবেশ করেনি, এসব ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই বেশি ঘটে থাকে। কিংবা ক্রয় করলেও, নামে মাত্র কিছু শস্য ক্রয় করে গুদামে নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি টাকা লোপাট হয়েছে। আর দেড় কোটি টাকারও অধিক টাকার চাল দীর্ঘদিন ধরেই আস্তে আস্তে কৌশলে চুরি করা হয়েছে। এটা দুই একদিনে সম্ভব হয়নি।

অভিযুক্ত ওসি (এলএসডি) আনোয়ারা বেগম এখনও ধরাছোঁয়ার বাহিরে! পৌনে দুই কোটি টাকার সরকারী চাল আত্মসাৎ করেও এখন ধরাছোঁয়ার বাহিরে অভিযুক্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা বেগম। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পক্ষ থেকে থানায় এজাহার দিলেও সেই মামলা রেকর্ড হয়নি এখনও! সরকারি চাল চুরি এবং সরকারি কর্মকর্তা জড়িত থাকায় পুরো ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর তফসিলভুক্ত হওয়ায় পুলিশের পক্ষ থেকে এজাহার দুদকে পাঠানো হয়েছে।

গত ৮ মে থানা পুলিশ দিনাজপুরের পুলিশ সুপারের মাধ্যমে নথি দুদক জেলা কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। পুলিশের কাছে থেকে প্রাপ্ত চাল আত্মসাতের এজাহার ও ঘটনার তথ্য জেলা কার্যালয় থেকে দুদক সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন দিনাজপুর জেলা দুদক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন।

সরেজমিনে শুক্রবার বিকেলে তার স্বামীর বাড়ি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার নুনিয়াগাড়ী-মন্ডল পাড়ায় গিয়ে খোঁজ মেলেনি তার।

প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, অভিযুক্ত আনোয়ারা বেগম আব্দুল মতিন মন্ডলের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার স্বামী মতিন পলাশবাড়ী পৌর শহরে লাইব্রেরি ব্যবসা করেন। উপরে টিনের চালা দেওয়া ইটের বাড়িটিতে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন তার স্বামী। প্রতিবেশীরা কোন দিনই আনোয়ারাকে ওই বাড়িতে বসবাস করতে দেখেননি।

প্রতিবেশী নারগিস বেগম নামে এক গৃহবধূ বলেন, তার (আনোয়ারা) ইতঃপূর্বেও এক জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরের একটি সন্তানও আছে। পরে মতিন ভাইকে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমরা জানি সে ঘোড়াঘাটে চাকরি করে এবং সেখানেই বসবাস করে। অভিযুক্ত আনোয়ারার বাবার বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলায়।

মুঠোফোনে তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তার ভাই বলেন, “আমার বোন কোথায় আছে আমরা জানিনা। সরকারি চাল আত্মসাতের বিষয়েও আমাদের কিছু জানা নেই। আমার বোন যদি অপরাধ করে থাকে, তবে সে সাজা পাবে।”

কি বলছেন সংশ্লিষ্টরা:

দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী বলেন, তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার দাখিল করা হয়েছে। পলাতক গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারাকে সাময়িক বহিষ্কার করেছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা প্রহরীকে আমি সাময়িক বরখাস্ত করেছি।”

দিনাজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, “খাদ্য বিভাগের পক্ষ থকে থানায় এজাহার দিয়েছেন। সরকারি চাল আত্মসাৎ এবং সরকারি কর্মকর্তা জড়িত থাকার ঘটনাটি দুদকের নথিভুক্ত হওয়ায় আমরা এজাহারের অনুলিপি দুদক কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”

এদিকে দুদক দিনাজপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “দুর্নীতি তদন্ত বা মামলা গ্রহণের পূর্বে আমাদেরকে আমাদের কমিশন থেকে অনুমোদন নিতে হয়। খাদ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাল আত্মসাতের নথি আমরা ঢাকায় পাঠিয়েছি। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর আমরা এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”

বিআরইউ

Link copied!