Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪,

নৌকা বাইচ তার নেশা, কখনই হননি পরাজিত

জাহিদ হাসান, মাদারীপুর থেকে

জাহিদ হাসান, মাদারীপুর থেকে

জুলাই ৩, ২০২৪, ০৬:৩৬ পিএম


নৌকা বাইচ তার নেশা, কখনই হননি পরাজিত

কিশোর বয়স থেকেই বাইচের নৌকার বৈঠা নিয়ে গিয়েছেন প্রতিযোগিতায়। পৈত্রিক সূত্রে অনেক সম্পদের মালিক হওয়ায় শখ পূরণ করতে তৈরি করেন বাইচের নৌকা। নৌকা বাইচই তার নেশা।

প্রতিযোগিতায় গিয়ে কখনো হননি পরাজিত। পুরোনো নৌকাটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছর যেতে পারেননি নৌকা প্রতিযোগিতায়। তাই শখ পূরণ করতে তৈরি করছেন নতুন নৌকা। আসছে বর্ষায় আশপাশের যেখানেই নৌকা বাইচ হবে সেখানেই অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত তার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফের শখ পূরণে ব্যয় করেছেন সাড়ে দশ লাখ টাকা। তৈরি করেছেন ১০০ হাত লম্বা একটি বাইচের নৌকা।

শখ পূরণের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে রেখে যেতে চান বাংলার এ জনপ্রিয় সংস্কৃতির সাথে। যুগ যুগ তারা যেন এ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারে এমন প্রত্যাশা তার। তার এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহলসহ উপজেলা ও জেলা প্রশাসন।

আবহমান কাল থেকে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের সাথে নৌকাবাইচ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এক সময় নদ-নদীতে প্রবাহ থাকায় সারা দেশেই নৌকা বাইচ একটি অসম্ভব জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়। ছোটবেলায় সেই নৌকাবাইচ দেখে প্রবল আগ্রহ জাগে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ভাটবালি গ্রামের দেলোয়ার আকনের। কিশোর বয়সে নৌকা বাইচের নৌকায় বৈঠা চালক হিসেবে তার শখ পূরণ করলেও এক সময় তৈরি করেন ৮০ হাত একটি বাইচের নৌকা। সেটা দিয়ে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নৌকা বাইচে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। নৌকাটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন দূরে ছিলেন নৌকা বাইচের।

জীবনের হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশার মধ্যেও তার জীবনে একটি বড় জায়গা করে নেয় বাইচের নৌকা। বাইচে প্রতিযোগিতা রীতিমতো তার নেশায় পরিণত হয়। শখ পূরণে পিছপা হননি ষাটোর্ধ্ব দেলোয়ার আকন। তার সাথে বাইচে যাওয়া বৈঠা কর্মীদের অনুরোধে সিদ্ধান্ত নেন নতুন বাইচের নৌকা তৈরির।

যেমন চিন্তা তেমন কাজ। কয়েক মাস আগে নতুন একটি বাইচের নৌকা তৈরির কাজে হাত দেন তিনি। ১০০ হাত লম্বা একটি বাইচের নৌকা তৈরির মূল কাজ শেষ করেছেন। নিজ বাড়ির আঙিনায় বসে তৈরি করা হচ্ছে নৌকাটি। ৬ জন মিস্ত্রির সব মিলিয়ে প্রায় দুই মাস সময় লেগেছে বলে জানায় মিস্ত্রিরা। নৌকাটি তৈরিতে তেমন কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়নি বলেও জানায় মিস্ত্রিরা। সাজগোজ ছাড়া তেমন কোনো কাজ বাকি নেই বললেই চলে। নৌকাটি তৈরি করতে সাড়ে দশ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এছাড়া চলতি বছরে নৌকা বাইচ হলে নতুন নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাদারীপুরের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার ও পালরনদীসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার যেখানেই নৌকা বাইচ হবে সেখানেই অংশ নিবেন তিনি।

তার কয়েকজন বৈঠা কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, নতুন নৌকাটি নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বেশ আগ্রহী তারা। এছাড়া কিছু কিশোর-যুবকেরাও জীবনের প্রথম বাইচের নৌকায় বৈঠা বাইতে পারবেন বলে বেশ আনন্দিত। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও শখ পূরণের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হলেও দেলোয়ার আকনের মধ্যে কোন চিন্তার ছাপ নেই। আছে আনন্দের বহি:প্রকাশ। এ বয়সে এসে সে যেন নতুন কোনো আনন্দময় জীবনের উপজীব্য হিসেবে বরণ করছেন নৌকাটিকে। 
নৌকার কারিগর (মিস্ত্রি) সুনীল বাড়ৈ বলেন, নৌকাটি মালিকের মনের মত করে তৈরি করা হচ্ছে। আধুনিক তেমন কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়নি নৌকাটি তৈরিতে। ৬ জন মিস্ত্রির প্রায় ২ মাস সময় লেগেছে। এখন শুধু রং ও সাজগোজের কাজ বাকি আছে।

নৌকার মালিক দেলোয়ার আকন বলেন, ১৬ বছর বয়স থেকে বাইচের নৌকায় বৈঠা বাইতাম। জয় পরাজয়ের মধ্যদিয়ে দিনগুলো কাটলেও ১৫ বছর আগে একটি নৌকা তৈরি করেছি। সেটি নিয়ে প্রতিযোগিতা করে কখনো পরাজিত হননি। শেষ জীবনে নতুন প্রজন্মকে এ সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এ উদ্যোগ আমার। সাড়ে দশ লাখ টাকা ব্যয় হবে নৌকাটি তৈরি করতে প্রশাসন থেকে কিছু সহযোগিতা পেলে ভালো হতো।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. মারুফুর রশীদ খান বলেন, সংস্কৃতি ধরে রাখতে তার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তারমতো আরও অনেকেই এগিয়ে আসুক এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে। সহযোগিতা চাইলে সাধ্যমতো চেষ্টা করা হবে।

ইএইচ

Link copied!