Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

চুয়াডাঙ্গায় ৪৫ দিনে ৮টি হত্যাকাণ্ড: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তড়িৎ পদক্ষেপে আসামি আটক

এসসিডি বাঁধন, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা)

এসসিডি বাঁধন, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা)

নভেম্বর ১৭, ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম


চুয়াডাঙ্গায় ৪৫ দিনে ৮টি হত্যাকাণ্ড: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তড়িৎ পদক্ষেপে আসামি আটক

চুয়াডাঙ্গায় হঠাৎ বেড়েছে হত্যাকাণ্ড। গত দেড় মাসে ৮টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে জেলায়। পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তড়িৎ পদক্ষেপে হত্যার রহস্য উন্মোচন ও আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত ৪ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা ভালাইপুর গ্রামের আলমগীর হোসেনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ২ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি।

২০ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা শহরতলি দৌলতদিয়ার দক্ষিণপাড়ায় বাড়িতে চুরি করতে এসে অঞ্জলি প্রামাণিক নামের এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে।

২১ অক্টোবর আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জে শিলা খাতুন (২৩) নামের এক গৃহবধূকে কুপিয়ে হত্যা করে মরদেহ রেললাইনের ওপর তার স্বামী ফেলে রাখে। পরে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও স্বামী রাসেল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

২৬ অক্টোবর পুলিশ জীবননগর উপজেলার ঘাড়কাটি বিল থেকে নিখোঁজ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক সুজন আলীর (৩০) কঙ্কাল উদ্ধার করে। ৬ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ ছিলেন শিক্ষক সুজন আলী।

এ হত্যারও রহস্য উদঘটান করে ৩ ঘাতককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

৩০ অক্টোবর দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে বিএনপির দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত বিএনপি নেতা সুলতান হোসেন (৪৫) মারা যান।

গত ২৩ অক্টোবর সুলতান ও আরিফুল ইসলাম আরিফের দু’গ্রুপের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নিলে সুলতান হোসেন গুরুতর জখম হয়। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুলতানের মৃত্যু হয়।

১২ নভেম্বর আলমডাঙ্গা উপজেলার আসাননগর গ্রামে পরকীয়ার জেরে অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্বামী রবিউলের বিরুদ্ধে। পরিবারের সবার সামনেই রবিউল তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী পলি খাতুনকে মারধর করেন। পরে তার মৃত্যু হয়।

১৩ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় তুষার আহমেদ সবুজ (২৩) নামের এক মোটরসাইকেল ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেলসহ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ চাঞ্চল্যকর তুষার আহমেদ সবুজ হত্যা মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ।

সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাজরাহাটি-বোয়ালমারী গ্রামের চরের মাঠ থেকে স্বামী পরিত্যক্তা টিকটকার খালেদা আক্তার মুন্নীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মানিক আলী মুন্সি ও তার সহযোগী পারভেজ মহাসিন স্বপনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত ৪ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুরের পাকি ভ্যানচালক আলমগীর হোসেনের (৪০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজের দুইদিন পর চিৎলা গ্রামের রাস্তার পাশে বাঁশবাগান থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আলমগীর হোসেন একই উপজেলার ভালাইপুর গ্রামের মাঝেরপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে। গত ২ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে তার ব্যাটারিচালিত ভ্যান নিয়ে বের হয়ে আর বাড়ি ফেরেননি আলমগীর হোসেন। ভ্যান ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুতই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

২০ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা শহরতলি দৌলতদিয়ার দক্ষিণ পাড়ায় অঞ্জলি প্রামাণিক (৫৫) নামে এক নারীকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। অঞ্জলি প্রামাণিক দৌলতদিয়ার দক্ষিণপাড়ার গণেশ প্রামাণিকের স্ত্রী ছিলেন।

এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। চুরির উদ্দেশ্যে এসে ওই নারীকে গলাকেটে হত্যা করে নগদ টাকা ও স্বর্ণ লুট করা হয়।

২১ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জে শিলা খাতুন (২৩) নামের এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শিলা খাতুন আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের রোয়াকুলি গ্রামের রাসেলের স্ত্রী ছিলেন। স্বামী রাসেল ইসলাম তার স্ত্রী শিলা খাতুনকে কুপিয়ে হত্যা করে রেললাইনের ওপর রেখে যায়।

চার বছর আগে উপজেলার বলিয়ারপুর গ্রামের হামিদুল ইসলামের মেয়ে শিলা খাতুনের সঙ্গে জেহালা ইউনিয়নের রোয়াকুলি গ্রামের রাসেল ইসলামের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের দাবিতে বিভিন্ন সময় শিলা খাতুনকে অত্যাচার করতো স্বামীর পরিবার। ২১ অক্টোবর স্বামীর সঙ্গে শিলার বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে রাসেল তার স্ত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। মরদেহ মুন্সিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ফেলে দেয়। এ ঘটনায় শিলা খাতুনের ভাই পোড়াদহ রেলওয়ে থানায় মামলা করেন।

পরে শিলা খাতুনের স্বামীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

২৬ অক্টোবর জীবননগর উপজেলার ঘাড়কাটি বিলের কচুরিপানার ভেতর থেকে নিখোঁজ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক সুজন আলীর (৩০) কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। সুজন আলী হাবিবপুর গ্রামের মরহুম আব্দুল খালেকের ছেলে। মরদেহ উদ্ধারের ২০ দিন আগে ৬ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ ছিলেন শিক্ষক সুজন আলী।

এ হত্যারও রহস্য উদঘটান করে পুলিশ। গলিত মরদেহ উদ্ধারের দুইদিনের মাথায় পুলিশ ৩ ঘাতককে গ্রেপ্তার করে। ঘাতকেরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সুজন আলীকে পালাক্রমে বলাৎকারের পর তাকে হত্যা করে বিলের কচুরিপানার মধ্যে লাশ ফেলে দেয়।

৩০ অক্টোবর দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে বিএনপির দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত বিএনপি নেতা সুলতান হোসেন (৪৫) মারা যান। ৩০ অক্টোবর রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সুলতান হোসেন জগন্নাথপুর খলিশাপাড়া গ্রামের মৃত আফসার ব্যাপারীর ছেলে ও ওয়ার্ড বিএনপি নেতা।

জানা গেছে, এর আগে গত ২৩ অক্টোবর মো. সুলতান ও আরিফুল ইসলাম আরিফের (৩৮) দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নিলে সুলতান হোসেন গুরুতর জখম হন। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুলতানের মৃত্যু হয়।

১২ নভেম্বর আলমডাঙ্গা উপজেলার আসাননগর গ্রামে পরকীয়ার জেরে অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে স্বামী রবিউলের বিরুদ্ধে। পরিবারের সবার সামনেই রবিউল তার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী পলি খাতুনকে মারধর করে। পলি খাতুন আলমডাঙ্গার কালিদাসপুর ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের গিয়াসউদ্দিনের ছেলে ট্রাকচালক রবিউল ইসলামের স্ত্রী ও হারদী ইউনিয়নের গোপালদিয়াড় গ্রামের ফরিদ উদ্দিনের মেয়ে।

স্বামী রবিউল এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে রবিউলের সঙ্গে পলির প্রতিনিয়তই ঝগড়াঝাঁটি চলতে থাকে। এর জের ধরেই রবিউল পলিকে ঘরের ভেতর মারধর করতে শুরু করে। ৬ মাসের অন্তসত্ত্বা পলি কান্নাকাটি করলে প্রতিবেশীরাও এগিয়ে যায়। তখনই রবিউলের বাবা বলতে থাকেন পলি বিষ খেয়েছে। তাকে ডাক্তার শহিদুলের কাছেও নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তার আগেই পলির মৃত্যু হয় বলে জানান ডাক্তার শহিদুল ইসলাম।

সংবাদ পেয়ে গোপালদিয়াড় গ্রাম থেকে ছুটে আসেন পলির বাপ-ভাইয়েরা। তারা হত্যা করা হয়েছে দাবি করে থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন।

১৩ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় তুষার আহমেদ সবুজ (২৩) নামের এক মোটরসাইকেল ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেলসহ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। আলমডাঙ্গা উপজেলার ফরিদপুর ও বেলগাছি গ্রামের মাঠের একটি মেহগনি বাগান থেকে ভস্মীভূত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সবুজ আলমডাঙ্গা উপজেলার বাদেমাজু গ্রামের জয়নাল হোসেনের ছেলে। সবুজ পুরাতন মোটরসাইকেল বেচাকেনার ব্যবসা করতেন।

এ চাঞ্চল্যকর তুষার আহমেদ সবুজ হত্যা মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব ও আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আসামি সাগর ও অন্য আসামি জহুরুল ইসলাম টাকার জন্য সবুজকে বাইক বেচাকেনা এবং গাঁজা খাওয়ার কথা বলে কৌশলে ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। পূর্বপরিকল্পিতভাবে সবুজকে হত্যা করে তার কাছে থাকা টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে আলামত ধ্বংসের জন্য মোটরসাইকেলসহ জ্বালিয়ে দেন।

সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাজরাহাটি-বোয়ালমারী গ্রামের চরের মাঠ থেকে স্বামী পরিত্যক্তা টিকটকার খালেদা আক্তার মুন্নীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। খালেদা আক্তার মুন্নী (২২) আলমডাঙ্গা উপজেলার ভাংবাড়িয়া গ্রামের মৃত খোয়াজ আলীর মেয়ে।

হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মানিক আলী মুন্সি ও তার সহযোগী পারভেজ মহাসিন স্বপনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মুন্নী ৯ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। পাঁচদিন পর ১৪ নভেম্বর তার অর্ধগলিত বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার হয়।

তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, মুন্নী পূর্বে মানিকের সাথে সম্পর্কিত একটি ব্ল্যাকমেইলিং ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। এক সময় মুন্নী মানিকের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে এবং তারপর থেকে মানিকের মধ্যে ক্ষোভ জমে ওঠে। পরে, ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় মানিক এবং তার সহযোগী পারভেজ আবারও মুন্নীকে ডেকে নেয় বোয়ালমারী শ্মশান এলাকায়। ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে মুন্নী সেখানে গিয়ে দুজনের সাথে শারীরিক সম্পর্কে রাজি হয়। তবে টাকা দেয়ার সময় ৫ হাজার টাকা দিলে মুন্নী ক্ষুব্ধ হয়। এ সময় সে চিৎকার করতে গেলে মানিক ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। হত্যার পর তাকে হাত-পা বেঁধে জঙ্গলে ফেলে চলে যায়।

গ্রেপ্তার আসামিরা তাদের অপরাধ স্বীকার করে এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, মুন্নী তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল এবং ওই ঘটনার পর মানিক প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করে। এই হত্যাকাণ্ড চুয়াডাঙ্গা শহরের জনগণের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে এবং এটি একটি সতর্কবার্তা হয়ে উঠেছে যে, প্রতিশোধের কারণে এমন সহিংসতা হতে পারে।

চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বিপিএম সেবা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জেলার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে। নানা পরিস্থিতির মাঝেও পুলিশ বাহিনী তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে চলেছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রত্যেক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছি।

ইএইচ

Link copied!