Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪,

গণঅভ্যুত্থানের গাথা

আরিফের স্বপ্ন কী পূরণ হবে?

ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ১১:১৪ এএম


আরিফের স্বপ্ন কী পূরণ হবে?

আরিফের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে একজন ভালো মানুষ হবেন। জীবন নির্বাহে একটা ভালো চাকরির মাধ্যমে দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন।

নিজের অসচ্ছল পরিবারকে সচ্ছল করার তাড়নাও তার স্বপ্নের অংশ। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের উপর পুলিশের চালানো অস্ত্রের একটি বুলেট তার নির্ভেজাল সেই স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছে।

স্বপ্ন ভঙ্গ হতভাগ্য তরুণের নাম আরিফ। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামের মৃত আবুল কাশেম ও আন্না খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে আরিফ।

ধলাপাড়া কলেজ থেকে গত এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.০৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে অংশ নিয়ে আরিফ পিঠে পুলিশের বুলেটে গুরুতর আঘাতে আহত হয়ে এখনো শয্যাশায়ী। একরকম স্থবির জীবনযাপন এখন তার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরিফ তার দরিদ্র পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। এখন তার অবস্থায় পরিবার বেকায়দায়। নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারা না পারা এখন অদৃষ্ট। ফলে অনিশ্চয়তার দোলাচলে আরিফের পরিবার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয়ার পর পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয় তার। বুলেট বুকের পাঁজর ভেদ করে বাম হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। খাদ্যনালীও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। সেদিন আরিফ ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু ৫০ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে  তাকে। শেষ করে এখন বাড়ি ফিরেছেন। খাবার খাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে হয় তাকে। এ ব্যথা প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়।

আরিফের বাবার মৃত্যুর পর তার মা অসুস্থ থাকার কারণে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে। বিবাহিত জীবনে আরিফের স্ত্রীসহ দেড় মাসের একটি ফুটফুটে সন্তান রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, একটি টিনের ঘরে আরিফের পরিবারের বসবাস। সাংবাদিক এসেছেন শুনে তিনি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। যদিও পুরো মুখে ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্নতার ছাপ। এদিকে মুহুর্তের মধ্যে এলাকার লোকজন তার বাড়িতে এসে ভিড় জমাতে শুরু করে।

আন্দোলনের ঘটনার বর্ণনায় আরিফ হোসেন বলেন, শুরু থেকেই আমি ঘাটাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই।  ১৯ জুলাই চাচাতো ভাই রায়হান সিঙ্গাপুর চলে যাবে বিধায় তাকে নিয়ে ঢাকায় এয়ারপোর্টে পোঁছে দেই। এরপর ঢাকায় থেকে যাই। পরের দিন বন্ধুদের সাথে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেই। সেদিন আমরা বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রায় ৬০ ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। আমরা যখন মিছিল শুরু করি তখন হঠাৎ পুলিশের তিনটি গাড়ি আসে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। হঠাৎ একটি গুলি আমার পিঠে বিদ্ধ হয়ে বুকের পাঁজর ভেদ করে হাতের ডানা ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এর পর আমি আর কিছুই জানি না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ ৫০ দিন চিকিৎসা শেষে  গত ৯ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরি। এখন বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার বলেছে, আরও তিন বছর চিকিৎসা করাতে হবে। আমি ১৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি খরচে চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছি। সংসারের খরচ বহন করে পরিবারের পক্ষে আমার চিকিৎসা খরচ আর বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরিফের মা আন্না খাতুন (৫০) জানান, গত ২০ জুলাই ঢাকার উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বন্ধুদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে আরিফ পুলিশের ছোঁড়া গুলি পিঠে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।  তাকে সহপাঠীরা উদ্ধার করে প্রাথমিক অবস্থায় ১৩ নম্বরে উত্তরা স্পেশালিস্ট হাসপাতালে ভর্তি করে। প্রথম দফায় অপারেশন শেষে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে পরের দিন আরিফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন ডাক্তাররা জানায়, গুলি লাগার কারণে আরিফের ফুসফুসের একো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। আবার জটিলতা বাড়োর ফলে তৃতীয় দফায় অপারেশন করা হয়। তখন আমরা সবাই ভেবেছিলাম ও আর বাঁচবে না। সকলের দোয়ায় আল্লাহ ওকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ জন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া।

তিনি আরও জানান, ঢাকায় চিকিৎসার সময়ে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ খরচ আমার পরিবারের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার কর্জ করতে হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ করার দুশ্চিন্তা আরিফকে আরো রোগা করে তুলছে। তারপর আরিফের চিকিৎসা, ঔষধপত্র কেনা, সংসারের খরচ বহন করে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব জানান, আরিফের চিকিৎসা বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে এখন আরও অর্থের প্রয়োজন। পরিবারের পক্ষে এ অর্থের জোগান দেয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আরিফের বিষয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে আরিফকে সুস্থ করতে অনেক সহজ হতো। স্বপ্ন পূরণের পথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে পারতো।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সামান্য কিছু সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে।

ইএইচ

Link copied!