বাগেরহাট প্রতিনিধি:
নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৩:৪০ পিএম
বাগেরহাট প্রতিনিধি:
নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৩:৪০ পিএম
দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে বাগেরহাট অন্যতম। প্রতিবছর-ই ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ একাধিক দুর্যোগ আঘাত হানে উপকূলে। এসব দুর্যোগে ভাঙে বাঁধ, ভাঙে মানুষের স্বপ্ন, নষ্ট হয়ে যায় উপার্জনের মাধ্যম। একই সাথে প্লাবিত হয় জনপদ। বছরের পর বছর সাগরের নোনা পানি প্রবেশের কারণে কৃষি জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির আঁধারগুলোও লবণাক্ত হয়ে পড়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট।
মাত্রাতিরিক্ত লোনাতে জমি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি ভুগছেন এসব এলাকার জনগোষ্ঠীও। বিশেষ করে পানি গোসল থেকে শুরু করে দিনের যাবতীয় কাজে লোনা পানির ব্যবহারে নানা রোগে ভুগছেন উপকূলের নারী, কন্যা ও শিশুরা। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার চলে এসব এলাকায়।
লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এ অঞ্চলের পরিবেশ ও লবণাক্ততা নিয়ে কাজ করা গবেষক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাটি মূলত উষ্ণ নোনা ভূমির অঞ্চল। তবে এ অঞ্চলের মাটিতে লবণের মাত্রা ছিল সহনীয়। ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে এই চিত্র পাল্টাতে থাকে। ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর চিত্র আরও বদলে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ জানতে ১৯৭৩ সালে প্রথম জরিপ চালায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। ওই জরিপে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত।
প্রথম জরিপের ২৭ বছর পর ২০০০ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তৃতীয় জরিপ পরিচালনা করে সংস্থাটি। মৃত্তিকা ও পানি লবণাক্ততা জরিপ-২০০০-এ দেখা যায়, লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর। ২০০৯ সালের জরিপে লবণাক্ত জমি বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টরে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৭ ভাগ।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেরিখালী এলাকার বাসিন্দা আকলিমা বেগম। প্রায় দুই যুগ আগে ঢাকা থেকে স্বামীর সাথে আসেন রামপালে।
তিনি বলেন, তখন থেকেই লবণ পানির ব্যবহার শুরু। বিভিন্ন সময় পেটে পীড়া, চর্মরোগসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছি। পরিবারের সদস্যদের অবস্থাও একই। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে—তারা সবসময় পেটব্যথা ও চর্মরোগে ভুগছে। সরকার যদি ঘোষিয়া খালি নদীর পাড় থেকে বেড়িবাঁধ ঠিক করে দেয়, তাহলে আমাদের এলাকায় আর লবণ পানি প্রবেশ করতে পারবে না। আমরা একটু ভালো থাকতে পারতাম।
এলাকার ভ্যানচালক আলতাফ হোসেন বলেন, চারদিকে শুধু লবণ পানি আর লবণ পানি। আমার পরিবারের ৬ জন সদস্য। প্রতিদিন যে কয় টাকা আয় করি, তা রোগের কারণে চলে যায়। খাব কী? আজ চলব কীভাবে.?
কাঁকড়া বুনিয়ার দাওয়াতখালী এলাকার হিলামা পাল বলেন, নদীতে যেসব নারী জাল টানে, তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে অ্যালার্জি, ঘা-পাঁচড়া এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া দেখা দেয়। অনেকের টিউমার হচ্ছে। অকাল গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটছে। দীর্ঘদিন লবণ পানিতে কাজ করার ফলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে।
কয়েকবছর আগে অপারেশন করে জরায়ু ফেলে দেওয়া খাদিজা আক্তার জানান, ‘লোনা পানিতে নামলেই শরীর চুলকাতো। কিন্তু মিঠে পানি পাব কোথায়? এভাবে চলতে চলতে একসময় নিয়মিত রক্ত পড়তে থাকলো। পরে ডাক্তার জরায়ু অপারেশনের পরামর্শ দিলো। না খেয়ে টাকা জোগাড় করে অপারেশন করেছি।
সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করে। এর ফলে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয় তারা।
লোনা পানির কারণে নারীদের গর্ভপাত হয় বলেও আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে। এদিকে ক্ষতিকর হলেও নারীদের জীবিকার জন্য নির্ভর করতে হয় লোনা পানির উপরেই।
রামপালে নিপুণ বিশ্বাস নামের চল্লিশ বছর বয়সী এক নারী বলেন, স্বামী মারা গেছে তিন বছর আগে। পরিবারের সব দায়িত্ব আমার। একদিন যদি নদীতে মাছ ধরতে না আসি, না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। রোগব্যাধি হয়, তারপরও বাধ্য হয়ে আসতে হয়। এই নদীতে মাছ ধরে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচও চালাতে হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ বলেন, লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে আমাদের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। সুপেয় পানির সংকট উপকূলের ৭৩% মানুষকে ভোগাচ্ছে। নারীরা জরায়ু ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পানির অভাবে মানুষ ও প্রাণিকুলের জীবনও বিপন্ন। এছাড়া, জলজ প্রাণী, পাখি এবং গাছপালার অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকশী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো লবণাক্ততা। প্রতিনিয়ত লবণ পানি ব্যবহারে চর্মরোগ, বদহজম, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে অকালে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে সমন্নিত পরিকল্পনায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যোগ করেন তিনি।
বিআরইউ