Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫,

সিলেট সীমান্তে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে চোরাচালান ও হত্যাকাণ্ড

সিলেট ব্যুরো

সিলেট ব্যুরো

জানুয়ারি ৯, ২০২৫, ০২:৩০ পিএম


সিলেট সীমান্তে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে চোরাচালান ও হত্যাকাণ্ড

সিলেট সীমান্তে চোরাচালান ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় খাসিয়ারা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে কিছু বাংলাদেশি চোরাকারবারি। দুই পারের এই চোরাচালান চক্রের লোভের শিকার হচ্ছেন সীমান্তবর্তী হতদরিদ্র জনগণ। সামান্য অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে চোরাই পণ্য আনা-নেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত, চোরাকারবারি সিন্ডিকেটগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই সীমান্ত এলাকায় সহিংসতা ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে অনুপ্রবেশের প্রবণতাও। এসব ঘটনায় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আতঙ্ক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকাগুলো এখন চোরাচালানিদের হটস্পট হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে চোরাচালানিরা মাদক, চিনি, কাপড়, কসমেটিকস পণ্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করছে। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে কৌশল বদলেছে চোরাকারবারিরা। সচেতন নাগরিকেরা বলছেন চোরাচালান রোধে সীমান্তে বিজিবির টহল আরো জোরদার করতে হবে।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় খাসিয়াদেরকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার দরকার।

এদিকে পুলিশ বিজিবির অভিযান, গ্রেফতার কড়াকড়িতেও চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না। এসব অভিযানে চোরাই পণ্য জব্দ হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে মূলহোতারা। যারা ধরা পড়ছে এবং যাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তারা এসবের বাহক মাত্র। এতে বিজিবির লোক দেখানো অভিযান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সূত্র জানায়, চোরাচালানের পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতের ব্যবসায়ীদের হাতে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে সীমান্তে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। তবে পুলিশ ও বিজিবি জানিয়েছে, আগের চেয়ে সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে।

সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত। প্রতিদিন আসছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। এ ছাড়া বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য আসছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

চোরাচালানের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বিজিবির দাবি- চোরাকারবারিরা অন্তর্কোন্দলে জড়িয়ে পড়ায় বাড়ছে হত্যা।

জানা গেছে, গত ৬ জানুয়ারি সিলেট সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে। সোমবার বিকেলে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বড় কেয়ারা সীমান্ত এলাকায় এই হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম জহুর আলী (৬০)। চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ডুলনা গ্রামের মনসুব উল্লাহর ছেলে।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও সীমান্তের ওপারের ভারতীয় লোকজন তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। নিহতের মরদেহ ভারতীয় পুলিশ উদ্ধার করে ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরে সিলেটের চার সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় খাসিয়াদের হাতে ৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর দমদমিয়া বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকার সীমান্ত পিলার ১২৬১ থেকে আনুমানিক ২০০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে সবুজ মিয়া (২২) নামের এক বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তিনি গোয়াইনঘাটের ভিতরগুল গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে। এর একদিন আগে গত ২৬ ডিসেম্বর মিনাটিলা বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকার সীমান্ত পিলার ১২৮২/৭-এস হতে আনুমানিক ৬০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে মো. মারুফ মিয়া (১৬) নামের এক কিশোরকে হত্যা করে ভারতীয় খাসিয়ারা। তিনি জৈন্তাপুর উপজেলার ঝিংগাবাড়ি গ্রামের শাহাবুদ্দিনের ছেলে।

তারও আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর খাসিয়াদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ গ্রামের আশরাফ উদ্দিনের। একই বছরের ১৪ জুলাই ভারত থেকে গরু আনতে গিয়ে খাসিয়াদের গুলিতে মারা যান দয়ারবাজারের কাউছার আহমেদ। একইদিনে খাসিয়াদের গুলিতে মারা যান কোমাপানীগঞ্জের আলী হোসেন। ২৪ অক্টোবর খাসিয়াদের হাতে তাহিরপুর উপজেলার অজ্ঞাত এক যুবকের মৃত্যু ঘটে। একই বছরের ৬ নভেম্বর মারা যান জৈন্তাপুরের জমির উদ্দিন। তারও আগে খাসিয়াদের হাতে প্রাণ হারান কানাইঘাটের মাসুম আহম্মেদ। তারা সবাই খাসিয়াদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে বিজিবি নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত চোরাকারবারিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি চোরাচালান পণ্য আসছে এই দুই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ভারতীয় চিনি, গরু, কসমেটিকস ও ঔষধ ভারত থেকে দেশে আনা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ থেকে পাচার রসুন ও দেশীয় ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ।

সূত্র আরো জানায়, ভারতীয় খাসিয়াদের সুপারিবাগান ও জঙ্গলের ভেতর হয়ে চোরাচালান পণ্য নিয়ে আসে বাংলাদেশি নাগরিকরা। এক বস্তা মালামাল ভারত থেকে নিয়ে এলে তারা পান ৫০০ টাকা। খাসিয়া ও বাংলাদেশি নাগরিকরা মিলেমিশে মালামাল আনা-নেওয়া করছেন। এতে করে চোরাচালানের টাকার ভাগ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। যে কারণে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে।

এদিকে, সিলেটে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি দুই ভারতীয় নাগরিককে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

বিজিবি জানায়, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার সীমান্তে দুপুর ১২টার দিকে লাফার্জ বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকার সীমান্ত পিলার ১২৩৯/এমপি হতে আনুমানিক ৯০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শ্যামারগাঁও নামক স্থান থেকে তাদের আটক করা হয়। তারা হলেন- শিলংয়ের ইস্ট খাসিয়া হিল জেলার সাইগ্রাম থানার কালাটেক গ্রামের তুফান বিশ্বাসের ছেলে নান্টু বিশ্বাস (২২) ও একই গ্রামের রাজেন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে সুবোধ বিশ্বাস (৬৫)। তারও আগে গত ২৯ ডিসেম্বর অনুপ্রবেশের অভিযোগে ডাব্বর লাং (২৬) নামে এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে বিজিবি। গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্ত পিলার ১২৭২/৬-এস সংলগ্ন নতুন সংগ্রামপুঞ্জি এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। ডাব্বর লাং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইস্ট খাসিয়া হিল জেলার পানিয়াসাল থানার লাপালং গ্রামের জুবেং সুটাংয়ের ছেলে।

এর আগে, গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতে বিএসএফের হাতে ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক আটক হন। আটককৃতদের মধ্যে ১০ জনের বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। বাকি তিনজন গোয়াইনঘাট উপজেলার বাসিন্দা। বিএসএফ জানিয়েছে, ২৩ ডিসেম্বর ভোররাত ৪টার দিকে বাংলাদেশের তামাবিল এলাকার বিপরীতে ভারতের ডাউকি এলাকার আনুমানিক ৫০০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে ১৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে অনুপ্রবেশ এবং চোরাচালানের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাদের ডাউকি থানায় হস্তান্তর করা হয়।

বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫৫ কোটি টাকার চোরাই পণ্য জব্দ করেছে সিলেট ব্যাটেলিয়ন ৪৮ বিজিবি। এছাড়াও গত ছয় মাসে সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশি-বিদেশি ৪১ জন নাগরিককে আটক করা হয়েছে। জব্দকৃত এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে নেশাজাতীয় ট্যাবলেট, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, গাঁজা, বিদেশি শাড়ি, কসমেটিকস, চিনি, গরুসহ দেশ থেকে পাচার হওয়া রসুনের চালান।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্র জানায়, জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত এক বছরে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে বিজিবির অভিযানে ১৫৫ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ১১৫ কোটি টাকা মূল্যের চোরাচালান পণ্য জব্দ করা হয়েছে।

সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে একে অন্যের প্রতি চড়াও হচ্ছে চোরাকারবারিরা।চোরাকারবারের টাকা নিয়ে ভারতীয় খাসিয়াদের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব হচ্ছে। আর এসবের বলি হচ্ছে পণ্য আনা-নেয়ার সঙ্গে জড়িত হতদরিদ্র লোকজন।

তিনি আরো বলেন, সীমান্ত দিয়ে দেশে কোনো অবৈধ পণ্য, মাদক কিংবা বিদেশি অস্ত্র যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। চোরাকারবারিদের দমন করতে বিজিবি বদ্ধপরিকর।

আরএস
 

Link copied!