আরিফ হোসেন,বরিশাল ব্যুরো
জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ১১:৩৯ পিএম
আরিফ হোসেন,বরিশাল ব্যুরো
জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ১১:৩৯ পিএম
অভাব-অনটনের কারণে সংসার চালাতে শিশুকাল থেকেই আমেনা ও মাইমুনা দুই বোন বরিশাল নগরীতে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করছে। আর সেই ফুল বিক্রির টাকা দিয়েই চলে তাদের অভাবের সংসার।
আট-দশ বছরের এই দুই শিশুকন্যার উপার্জন দিয়েই তাদের মা নুরুন্নাহর বেগম কোনোভাবে সংসার চালানোর কাজটি করছেন। জীবিকার তাগিদে ফুল বিক্রি করতে নেমে দুই বোনের পড়াশোনাও বন্ধের উপক্রম। তারপরও সংগ্রামের জীবনে জীবিকাই যে মুখ্য।
প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে সকাল নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও রাতে ঐতিহ্যবাহী বেলস্ পার্ক প্রাঙ্গণ ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রিই তাদের কাছে মূল আয়। তবে হঠাৎ করেই যেন ভাগ্য সহায় হয়েছে আমেনা ও মাইমুনার।
গেল পৌষের এক সন্ধ্যায় বেলস্ পার্ক প্রাঙ্গণে হাঁটতে যায় একজন মানবিক সমাজসেবক ও বরিশাল জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ। চোখ যায় শীতে কাঁপতে থাকা শিশু দুটির দিকে। বিবেকের তাড়নায় শিশু দুটিকে কাছে ডেকে তাদের বিষয়ে জানতে শুরু করেন সমাজসেবার এই কর্মকর্তা।
প্রাথমিকভাবে জানতে পারেন, শিশু দুটির বাড়ি নগরীর কীর্তনখোলা নদীতীরবর্তী রসূলপুর বস্তিতে। ছয়জনের পরিবারের তাদের বাবা তেমন একটা কাজকর্ম করেন না। বড় ভাইও দায়িত্বহীন। আর এরপরে আমেনা ও মাইমুনা দুই বোন, যারা সংসারের হাল ধরতে গিয়ে ফুল বিক্রি করেন ঘুরে ঘুরে। তাদের পর ৬-৭ মাস বয়সী আরও এক ছোটভাই রয়েছে।
সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ আমার সংবাদকে বলেন, বিষয়গুলো জানার পর প্রাথমিকভাবে শিশু দুজনকে শীতের কাপড় হিসেবে দুটি কম্বল দেয়ার ব্যবস্থা করি। এর পাশাপাশি তাদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করি। তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই করে শিশু দুটির পরিবার ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি। এরপর তাদের পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি করে দেই, তারা স্কুলেও যাচ্ছে। পাশাপাশি জীবিকার জন্য ফুলেরও ব্যবস্থা করে দেই।
তিনি আরও বলেন, অসহায় দুই বোনকে শীতে কাঁপতে দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে। তারপর আমি চিন্তা করতে থাকি তাদের জন্য কী করা যায়? এখন থেকে আমেনা ও মাইমুনা এই দুই বোনের পড়াশুনার দায়িত্ব আমার।
সমাজকর্মী কামরুন্নাহার ইভা আমার সংবাদকে বলেন, শিশু দুটির বিষয়ে সাজ্জাদ পারভেজ স্যার অবগত হওয়ার পর ওদের শীতের পোশাক দেয়ার পাশাপাশি আমাকে খোঁজ নিতে বলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, রসূলপুর কলোনীতে বাসায় ভাড়া নিয়ে থাকেন আমেনা ও মাইমুনার পরিবার।
তিনি বলেন, আমেনা ও মাইমুনার বাবা মাঝেমধ্যে মাছ বিক্রি করে থাকেন, তবে বেশিরভাগ সময়েই কাজ থাকে না তার। আর ওদের বড় ভাইও নিয়মিত কোনো কাজ করে না। ফলে সংসারে অভাব-অনটন লেগে থাকে। এ অবস্থায় কিছুদিন ধরে বেলস্ পার্কে সামান্য কিছু টাকার ফুল এনে বিক্রি শুরু করেন আমেনা এবং মাইমুনা। আর অভাবের কারণে আমেনা ও মাইমুনা নিয়মিত স্কুলেও যায় না।
তিনি আরও বলেন, বিষয়গুলো সাজ্জাদ পারভেজ স্যারকে জানালে তিনি ৮নং চকবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আমেনা ও মাইমুনাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। সেই সঙ্গে স্থানীয় একটা টেইলার্সে ওদের দুইবোনের স্কুল ড্রেস বানাতে দেন। পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ওদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিক্রির জন্য ফুলের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। তাদের পড়াশুনার দায়িত্ব নেন। সাজ্জাদ পারভেজ স্যারের সহযোগিতায় তারা আগের থেকে অনেক বেশি ফুল বিক্রি করতে পারবে, অন্য কাজগুলোর সঙ্গে সেই ব্যবস্থা সাজ্জাদ স্যার নিজের উদ্যোগেই করে দিয়েছেন। আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতেও কোনো বেগ পেতে হবে না। আমেনা ও মাইমুনা এখন নিয়মিত স্কুলেও যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ছোট ছোট মেয়ে দুটি শিক্ষার আলো পাবে এটাই আমার প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা থেকেই ওদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি, এটাই বড় প্রাপ্তি আমার। আমি তাদের পড়াশুনার জন্য যা যা দরকার তা করার চেষ্টা করে যাবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আশপাশে এরকম সুবিধাবঞ্চিত অনেক আমেনা ও মোহাইমিনা আছে, তাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। জনবান্ধব ও সাংবাদিকবান্ধব এই সমাজসেবা কর্মকর্তার ব্যতিক্রম কর্মোদ্যম, সৎ ও দায়িত্বশীলতা বরিশাল জেলায় দিন দিন যোগ যোগ হচ্ছে সহযোগিতার নতুন মাত্রা। তার সততা ও কর্মদক্ষতায় প্রতিদিন বরিশাল জেলা সমাজসেবা অফিসের সুনামের মাত্রা যোগ হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অসহায় মানুষের সহযোগিতার হাত। সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গরীর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর পাশে সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রতিদিনের রুটিনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিনি।
ইএইচ