এম এ মান্নান, চৌগাছা (যশোর)
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
এম এ মান্নান, চৌগাছা (যশোর)
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
যশোরের চৌগাছা উপজেলা ও ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা সীমান্তবর্তী সাতটি গ্রাম নিয়ে দুই উপজেলার মধ্যে রশি টানা চলছে চার দশক ধরে।
এতে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে (বিশ্বনাথপুর, শ্যামনগর, কমলাপুর, আলিশা, যদুনাথপুর, রাড়িপাড়া ও পাঁচবাড়িয়া) এই সাতটি মৌজার প্রায় ২০ হাজার মানুষ।
এই সাতটি মৌজার মানুষের সর্বশেষ আবেদনের প্রেক্ষিতে নিকার বৈঠকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে সাত গ্রামের মানুষ উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এই আপিলের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গণশুনানির জন্য বিভাগীয় কমিশনার খুলনাকে দায়িত্ব দেন।
সাত গ্রামের মানুষ চৌগাছায় থাকতে চান। ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চৌগাছা উপজেলা পরিষদের হলরুমে সাত গ্রামের মানুষের মুখে গণশুনানি গ্রহণ করেন তৎকালীন খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) আব্দুর রশিদ।
শুনানিতে উপস্থিত সাত গ্রামের গণমানুষের ভাষা ছিল, "আমরা ফিরে পেতে চাই আপন ঠিকানা চৌগাছা!" এ গণশুনানিতে প্রেসক্লাব চৌগাছার সভাপতি অধ্যাপক আবু জাফর, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এম এ রহিম, সুকপুকুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হবিবর রহমান, নারাণয়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমান, স্বরুপদাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল কদরসহ সাত গ্রামের মানুষ, সংবাদকর্মী ও উপজেলার সকল কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
শুনানির সময় বিভাগীয় কমিশনার সাত গ্রামের প্রত্যেকটি নাগরিকের বক্তব্য লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেন। শুনানি শেষে বিষয়টি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে সকলকে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও সেই গণশুনানির রিপোর্ট জানতে পারেনি এলাকাবাসী।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি রিট বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি ফারাহা মাহবুবের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ খারিজ করে দেন।
জানা যায়, দুই উপজেলার মধ্যে এই সাতটি গ্রাম নিয়ে প্রায় চার দশক ধরে রশি টানাটানি চলে আসছিল। সাতটি গ্রাম মহেশপুর উপজেলার পক্ষে রাখতে দায়ের করা একটি রিট হাইকোর্ট খারিজ করে দেওয়ায় গ্রামগুলো দ্বৈত শাসনের অবসান হয়।
রিটের নথি সূত্রে জানা যায়, সাত গ্রামের গণমানুষের আবেদনের প্রেক্ষিতে নিকার-৫৫তম বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা থেকে বিযুক্ত করে গ্রামগুলো যশোরের চৌগাছা উপজেলায় যুক্ত করা হয়। ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনে চৌগাছার অধিবাসী হয়ে গ্রামগুলোর মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। পরে ১৯৯৪ সালে সাত গ্রামের একাংশের জনগণের আবেদনের প্রেক্ষিতে নিকার-৮১তম বৈঠকে পূর্বের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এবং ৪ অক্টোবর ১৯৯৪ তারিখে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৭টি মৌজাকে পুনরায় মহেশপুর উপজেলায় যোগ করা হয়। বিষয়টি আলোচনায় আসলে তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মন্ত্রী পরিষদের সচিবের বরাবর প্রেরিত একটি উপানুষ্ঠানিক পত্রে পুনরায় সাত গ্রামকে চৌগাছা উপজেলায় সংযুক্তির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান।
১৯৯৪ সালের সীমানা কমিশনের রিপোর্টে সাতটি মৌজাকে পুনরায় যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় অন্তর্ভুক্তি করার সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ পত্রে বলা হয়, নিকার ৮১তম বৈঠকে যথাযথ বিবেচনা না করেই ৫৫তম বৈঠকের (৭টি মৌজা চৌগাছার সাথে সংযুক্তকরণ) সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। উপজেলা সদরের দুরত্ব, অর্থ ও সামাজিক বিষয় বিবেচনা করে ৭টি মৌজা যশোরের চৌগাছা উপজেলার সাথে যুক্ত করা যায়।
সুপারিশের ভিত্তিতে মহেশপুর ও চৌগাছা উপজেলার থানা পুনর্গঠনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিকারের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম সর্দার হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এম এ আজিজ ও বিচারপতি হুদার একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন। যার কারণে সাতটি গ্রাম চৌগাছার অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি স্থগিত হয়ে যায়। ফলে ৭টি গ্রামের প্রশাসনিক কার্যক্রম দুই উপজেলার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। প্রশাসনিক দায়িত্ব মহেশপুর উপজেলায় এবং সেচ-বিদ্যুৎ ও শিক্ষাবিষয়ে চৌগাছা উপজেলার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এ ব্যাপারে পাঁচবাড়িয়া গ্রামের বকুল হোসেন, মুকুল হুসাইন, রাশেদুল ইসলাম, রাড়িপাড়া গ্রামের পান্নু রহমান, ফরজান আলী, শ্যামনগর গ্রামের আব্দুল মালেক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সামসুল মাষ্টার, কমলাপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও যদুনাথপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তাহাজ্জেল হোসেন বলেন, "আমরা ৭ গ্রামের মানুষ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজসহ চাকরি প্রত্যাশী ছেলে-মেয়েদের চাকরির আবেদনে এবং চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় ঠিকানা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল কাজে সাত গ্রামের মানুষের যশোর জেলার চৌগাছাতেই সুবিধা বেশি। তাই আমাদের দাবি, পৃথক একটি নতুন ইউনিয়ন করে ঝিনাইদহ মহেশপুর থেকে আমাদেরকে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার অন্তর্ভুক্ত করা হোক।"
ইএইচ