রেদওয়ানুল হক ও জাহিদুল ইসলাম
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২, ০৮:৩৪ পিএম
রেদওয়ানুল হক ও জাহিদুল ইসলাম
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২, ০৮:৩৪ পিএম
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পাট শিল্পের জেড ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান জুট স্পিনার্স যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে। ডিএসইর তথ্যমতে, সবশেষ ৯৪ টাকায় থাকা শেয়ারটি তরতর করে বেড়ে সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ২৬৯ টাকায় পৌঁছেছে। কোন কারণ ছাড়াই বাড়তে বাড়তে গত ১৫ জুন ১২৫ টাকায় ওঠে শেয়ারটির দাম। এরপর পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। মাত্র ৬৪ দিনে ১৪৩ টাকা বেড়েছে। সবচেয়ে অস্থিরতা চলছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। মাত্র ১১ কার্যদিবসে ১১৮ টাকা বেড়েছে শেয়ারটির দাম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অস্বাভাবিক দামে যেকোন সময় বড় পতনের মুখে পড়তে পারে শেয়ারটি। এর ফলে কারসাজি চক্র লাভবান হলেও বড় ঝুঁকিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার সাথেও বিষয়টি জড়িত। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। অন্যদিকে মালিকপক্ষের লোকজনের হাত থাকায় অস্থিরতা বেড়েই চলেছে বলে ধারণা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রশ্ন রয়েছে বিএসইসির ভুমিকা নিয়েও।
ডিএসইর তথ্যমতে, গত ১৫ জুন শেয়ারটির দাম ছিল ১২৫ টাকা ৯০ পয়সা। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে আসার খবরকে পুঁজি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে কারসাজি চক্র। গত ৫ সেপ্টেম্বর ১৬০ টাকা ৮০ পয়সায় থাকা শেয়ারটি মাত্র ১১ কার্যদিবসে ১০৯ টাকা বেড়ে আজ ২৬৯ টাকা ১০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ডিএসই’র পক্ষ থেকে কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, কোন প্রকার মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই শেয়ারটির দাম বেড়ে চলেছে। ফলে দেউলিয়াত্বের পথে থাকা জুট স্পিনার্সের শেয়ার নিয়ে আসলে কি হচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে প্রায় অর্ধযুগ ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিলো না লভ্যাংশ, হয়নি আর্থিক প্রতিবেদন। বেতন-ভাতা সংকটে একের পর এক চাকরি ছাড়তে থাকলে কোলাহল শূণ্য হয়ে পড়ে প্রধান কার্যালয়।
বর্তমানে সেখানে ১০-১২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী দেখা মিললেও পুরো অফিস কক্ষই প্রায় নিরব। একমাত্র ব্যতিক্রম কোম্পানিটির শেয়ারদর। কোম্পানী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হয়তো উৎপাদনে আসার তথ্য কোনভাবে ফাঁস হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যতই তর্জন-গর্জন হোক, সবই অন্তঃসার শূণ্য। মূলত মার্কেট ম্যানিপুলেশনের উদ্দেশ্যেই এটা করা হচ্ছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের বিপরীতে যে পরিমাণ দায়-দেনা, তাতে আগামী এক দশকেও দাবীদাওয়া মিটিয়ে রাজস্ব হিসেবে মুনাফার অন্তর্ভূক্তি এক প্রকার অসম্ভব।
প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন বিনিয়োগকারী জানান, ২০১৬ সালের পর আর কোন এজিএম হয়নি জুট স্পিনার্সের। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বকেয়া পড়েছিল শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এদিকে সঞ্চয় ও উদ্বৃত্ত তহবিলে ঘাটতির পরিমান প্রায় ২৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। শেয়ারপ্রতি আয়ও চলে গিয়েছে ঋণাত্মক অবস্থানে, যেখানে শেয়ারপ্রতি ঘাটতি ৩২.৫০ টাকা। এরপরও বাড়ছে শেয়ারের দাম।
ডিএসই থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক কোটি ৭০ লাখ টাকার কোম্পানীর বর্তমান শেয়ারমূল্য ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিচালকদের মূলধন ৬৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪’শ টাকা এবং শেয়ার সংখ্যা ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৯৪০টি। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের রয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ৩০ হাজার ৬’শ টাকা বা ১০ লাখ ২৩ হাজার ৬০টি শেয়ার। এতো কম সংখ্যক মূলধন থাকায় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে একটি চক্র, এমনটাই মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
তবে দাম বৃদ্ধির কারণ জানা নেই, ইতোপূর্বে কোম্পানির পক্ষ থেকে এমনটা বলা হলেও গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি জানায় ফের উৎপাদনে আসছে জুট স্পিনার্স। চলতি মাসেই ফের সচল হবে কারখানার মেশিনারিজ। কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, মালিকপক্ষের ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলতি মাসেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। ইতোমধ্যে ঋণ দাতা ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ পরিদর্শন করে গেছে খুলনার কারখানা। তবে তিনি মনে করেন, উৎপাদনে আসার এই তথ্য হয়তো কোনভাবে প্রকাশ হয়েছে, যে কারণে বাড়ছে শেয়ারের দাম। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, উৎপাদনে আসার আগেই যে অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে উৎপাদন শুরু হলে শেয়ার দর আড়াই’শ টাকায় গিয়ে ঠেকবে।
বিনিয়োগকারীদের মতে, কোম্পানির যে অবস্থা তাতে আগামী এক দশকেও দায়-দেনা ও ক্ষতি কাটিয়ে মুনাফায় আসবে কিনা সন্দেহ। তারপরও এমন কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধির পেছনে হয়তো কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত রয়েছে। অনেকেই হয়তো মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানের নামে শেয়ার কিনে রেখেছেন। আগাম তথ্য প্রকাশ করে দাম বাড়িয়ে নিজেরা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ প্রদান করে আসছে জনতা ব্যাংক লিমিটেড। এখন পর্যন্ত জুট স্পিনার্সের মোট ঋনের পরিমাণ ৪০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদী ঋণ ৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের পরিমাণ ৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এসবের বাইরে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক লোকসান আছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। জুট স্পিনার্সের এক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি পুন:উৎপাদনের আসার পূর্বে খুলনার কারখানা পরিদর্শনে যায় জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এরপর কোম্পানির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ার কিনতে থাকে ব্যাংকটি। এছাড়া কোম্পানির কতিপয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে শেয়ার কিনে রাখছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন উৎপাদনের আসার এই খবরটি প্রকাশও কোম্পানির একটি অপকৌশল। তারা বলছেন, কোম্পানি ডিএসইকে জানিয়েছে তাদের কাছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। অথচ তারাই আবার বলছে উৎপাদনে আসছে। তাহলে কোনটা সঠিক? অনেকের মতে, এমন খবর প্রচার করে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কেউ হয়তো শেয়ার দর বাড়াতে চাইছেন।
দূর্বল মৌলভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের এমন উচ্চদরের কারণ জানতে চাইলে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মার্কেটে স্পেকুলেশন থাকবেই। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হোক বা বাংলাদেশেরই হোক। একজন শেয়ার কিনতে চাইলে তো বাঁধা দিতে পারি না। তবে মার্কেটে ম্যানিপুলেশন হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। আমরা এসব বিষয়ে তদন্ত করছি। অনিয়ম খুঁজে পেলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এবি