অক্টোবর ৩১, ২০২২, ০৭:১৫ পিএম
- অধিকাংশ পাচার ব্যবসায়ীক চ্যানেলে
- ২০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং
- এক বছরে ৮৫৭১ সন্দেহজনক লেনদেন, বেড়েছে ৬২ শতাংশ
- দেশে কার্যরত বিদেশী নাগরিকদের তথ্য নেই
- হুন্ডি তৎপরতা রোধে বিশেষ তদন্ত
বিদেশে অর্থপাচারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে প্রাতিষ্ঠানকিভাবে কোন সংস্থার পক্ষ থেকে অর্থ পাচারের কথা স্বীকার করার নজির নেই। বিএফআইইউ জানায়, সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে পাচার প্রবণতা থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকেও অর্থপাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা নগন্য। অধিকাংশ অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে ব্যবসায়িক চ্যানেলের মাধ্যমে। তবে ঠিক কি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার কোন তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে।
সোমবার (৩১ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গির আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংস্থাটির কার্যক্রম ও ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, টাকা বিদেশে চলে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন। বৈশ্বিকভাবে পাচারকৃত মোট অর্থের মাত্র এক শতাংশ উদ্ধার হওয়ার নজির আছে। তাই এটি ঠেকানোর জন্য আমরা কাজ করছি। অর্থপাচারের ধরণ বর্ণনা করে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্যমূল্য অতিরিক্ত দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) অর্থ পাচার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ’র তৎপড়তায় বিষয়টি ঠেকানো গেছে। বর্তমানে কম মূল্য দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে গাড়িসহ উচ্চ মূল্যের যেসব পণ্যে কর হার বেশি এসব ক্ষেত্রে কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। ফলে কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে তার সঠিক তথ্য গোপন থাকছে।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বিএফআইইউ উচ্চ আদালতকে জানায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় তারা। এজন্য ৩ মাস সময় বেধে দিয়েছে আদালত। বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে এই চুক্তি করতে যাচ্ছে বিএফআইইউ।
মতবিনিময় সভায় সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন জানান, গত এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে (এসটিআর) ৮ হাজার ৫৭১টি। এটি ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৬২.৩২ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছর এসটিআর’র পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ২০৮টি। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমন লেনদেন ও কার্যক্রম হয়েছিল ৩ হাজার ৬৭৫টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৭৩টি। করোনার সময়ে আর্থিক খাতে নগদ লেনদেন বৃদ্ধির কারণে বিদায়ী অর্থবছরে এই লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানায় বিএফআইইউ।
মাসুদ বিশ্বাস বলেন,সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) মানেই অপরাধ নয়। লেনদেন সন্দেহজনক হলে তদন্ত করি। এরপর যদি কোনও অপরাধের তথ্য প্রমাণ পাই তাহলে ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাধারণত তথ্য সংগ্রহের পর তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয় বিএফআইইউ। পরবর্তীতে বিধি অনুসারে ওই সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্ট অর্থপাচারকারীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিএফআইইউ নিজেই ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা এবং দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে। ৫২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর তদন্ত করে ৩০টির সারাংশ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঠিক স্ট্রাকচার, হিসাবপত্র না থাকা ও ব্যক্তি নির্ভর হওয়ায় অনিয়ম বেশি হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানায় সংস্থাটি। শুধুমাত্র ব্যাংক লেনদেনের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোয়েন্দা সংস্থা এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করে বিএফআইইউ। তবে বিগত অর্থবছরে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ কার্যক্রম নিজেদের উদ্যোগে করেছে বলে জানিয়েছে তারা। দায়িত্ব পালনে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ আছে কিনা, এমন প্রশ্নে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, কার্যক্রম পরিচালনায় কোন চাপ নেই, বিএফআইইউ শতভাগ স্বাধীন।
হুন্ডি তৎপরতা রোধে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করছে বিএফআইইউ। এই কার্যক্রমে জড়িত থাকায় দেশের কয়েকটি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এফএফএস) প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটরশীপ এবং কয়েক হাজার ব্যবসায়ির এজেন্টশীপ বাতিল করা হয়েছে।
এছাড়া বহির্বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০৩টি আবেদনের প্রেক্ষিতে ৯৯টি আর্থিক অনিয়ম ও অর্থপাচারজনিত সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এর বিপরীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২৬টি আবেদন পেয়েছে বিএফআইইউ।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের বিষয়ে তথ্য নেই তাদের কাছে। তবে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউ পরিচালক রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এবি