Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,

পরিচালনায় স্বদেশ না বিদেশ, গোলক ধাঁধার প্যাঁচে চট্টগ্রাম বন্দর!

মামুনুর রশিদ, বিশেষ প্রতিনিধি (চট্টগ্রাম)

মামুনুর রশিদ, বিশেষ প্রতিনিধি (চট্টগ্রাম)

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫, ০২:৩৫ পিএম


পরিচালনায় স্বদেশ না বিদেশ, গোলক ধাঁধার প্যাঁচে চট্টগ্রাম বন্দর!

দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর। এই বন্দরের গতি প্রবাহের উপর নির্ভর করে দেশের ভাগ্য।অনিয়ম দুর্নীতি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ ইত্যাদিতে স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলে লুটোপুটে খেয়েছে বিগত সরকারের আমলে। এতে জড়িত ছিল না এমন কেউ নেই। এতসবের পরও চট্টগ্রাম বন্দর বুক চিতিয়ে বৃদ্ধি করছে প্রবৃদ্ধি। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় একেই পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ গত সরকারের সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দিয়ে পরিচালনা করাতে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংগঠন ও একটি প্রভাবশালী চক্র।ফলে গোলক ধাঁধার প্যাঁচে পড়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বিদেশিদের দিয়ে বন্দর পরিচালনায় লাভের হিসেবে সর্বপ্রথম সরকার একটি সাইনিং মানি পাবে, অধিকতর রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, অধিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, দেশের বড় ধরনের কোন গোলযোগ যেমন অন্যদেশের সাথে যুদ্ধসহ ইত্যাদি ঝুঁকিতে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে,চিকিৎসা ভ্রমণ বাণিজ্যসহ যে কোনো প্রয়োজনে অবাধ যাতায়াতে সহজ হবে,দক্ষ তা বৃদ্ধিসহ আরো অনেক ধরনের সুবিধা ভোগ করবে দেশের মানুষ। বিদেশি পরিচালনার ফলে আমদানি রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধির ফলে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

অবাধ রপ্তানি আমদানি নীতির আলোকে বহুগুণ মুনাফা লাভের জন্য বিভিন্ন ফলজ সময়ে ফল সবজিসহ মানুষের ভোগ্য পণ্য ইত্যাদিতে উৎপাদন বাড়াবে। এতে দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা কাজে আসবে এবং দেশের মধ্যে বেকারত্ব হ্রাস পাবে।আমদানি যেমন হবে তেমনি আমদানিকৃত জাহাজ অবস্থানের ফলে প্রতিদিন ভাড়া হিসেবে একটি রাজস্ব অতিরিক্ত আসবে। অনিয়ম দুর্নীতি শতভাগ বন্ধ হবে। তাই বিদেশি দিয়ে বন্দর পরিচালনায় দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির সাথে সব ক্ষেত্রে লাভবান হবে দেশ।বন্দর ব্যবহারকারীরাও বলছেন একই কথা।

আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত। বিদেশি বিনিয়োগকারীর সাথে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের সমন্বয় করার পরামর্শ।স্টোকহোল্ডাররা বলছেন, বন্দরের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে।চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বর্তমান যুক্ত একমাত্র বিদেশি প্রতিষ্ঠান সৌদি আরব ভিত্তিক  প্রতিষ্ঠান আরএসজিটি।

এইটিকে সরকার বলছে বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো, দেশি অপারেটরদের যাচাই করা এবং সেইসঙ্গে ‘কষ্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ নিশ্চিত করা।সৌদি আরবের প্রথম বেসরকারিভাবে অর্থায়িত কোম্পানি রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) ২০২৪ সালের জুন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা করে আসছে। বে-টার্মিনাল লাল দিয়ার চরসহ অনেক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে এখন আগ্রহী বিদেশি প্রতিষ্ঠান। আগে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পিএসএ ডেনমার্কের মার্ক আবুধাবি পোর্টে বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচিত হলেও নতুন করে আলোচনায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ড এবং এপি মোলার মার্স্কের বিনিয়োগের কথা উঠে এসেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) কমোডর কাওছার রশিদ(ই)পিএসসি বিএন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগে দেশ দ্রুত গতিতে সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।খুব দ্রুত স্ক্যানার বসতে যাচ্ছে এবং গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ সকল যন্ত্রপাতি যোগ হবে। এতে ভিড়তে পারবে জাহাজ। বিদেশি বিনিয়োগে কেমন লাভবান হবো আমি কর্তৃপক্ষকে পুঙ্খানুপুঙ্খানুভাবে উপস্থাপন করেছি। তবে একটি মহল দেশের মঙ্গল না চেয়ে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র সচিব ওমর ফারুক দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন,সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। সরকারি পলিসি হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। আর আমরা সরকারের পলিসি বাস্তবায়ন করি।পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ(পিপিপি)‍‍’র মাধ্যমে যারা আগ্রহ দেখিয়েছে আমরা সবাইকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।

বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নির্মাণাধীন সাগর বেষ্টিত বে-টার্মিনাল নজর কাড়বে বিদেশিদের। রিং রোড দিয়ে ট্রাফিক ম্যানেজ করা সম্ভব না। যেহেতু টানেল আছে আনোয়ারাও ভবিষ্যতে ব্যবসা বাণিজ্যের শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। এর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সাজাতে হবে। বাংলাদেশের মোট কনটেইনার পণ্য ওঠানামার ৫৫ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি দিয়ে। সবচেয়ে আধুনিক সব যন্ত্রে সজ্জিত এই টার্মিনাল থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, ২০০৭ সালের আগে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভেড়ার আগে একটি কনটেইনার জাহাজকে বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকত গড়ে ১২ থেকে ১৫ দিন। আধুনিক যন্ত্র এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনায় জাহাজের গড় অপেক্ষমাণ সময় ১২ দিন থেকে কমে নেমে এসেছে দুই থেকে আড়াই দিনে।

বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার বিরোধিতা করছেন স্থানীয় অপারেটররা। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর এলে বন্দরের রাজস্ব আয় হবে ঠিকই, কিন্তু রাজস্বের সিংহভাগ চলে যাবে বিদেশে।

তাদের মতে, এনসিটি এখন যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের একক নিয়ন্ত্রণে আছে, সেটি আর থাকবে না। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে ৫৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামার জন্য বিকল্প কোনো টার্মিনালও নেই।

এছাড়া বিদেশি অপারেটর এলে এনসিটির পণ্য ওঠানামার খরচ বাড়বে বলে মনে করেন তারা। আর খরচ বাড়লে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বন্দর ব্যবহারকারীদের মতে, নতুন স্থানে একটি আধুনিক টার্মিনাল তৈরি করে সেটি পরিচালনার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য অপারেটরদের দেওয়া যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে চার গুণ বড় প্রস্তাবিত ‘বে-টার্মিনাল’ কিংবা ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর’, এমনকি ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরে’ নতুন টার্মিনাল নির্মাণে বিদেশিদের আগ্রহকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এতে বিদেশিরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে। বন্দরের টাকায় গড়া, বন্দরের কেনা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদেশি অপারেটরদের টার্মিনাল পরিচালনায় সফলতার কিছুই নেই। এসব বিবেচনায় এনসিটিতে বিদেশি অপারেটর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে স্থানীয় অপারেটররা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক–কর্মচারী ফেডারেশন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের দিলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে মনে করেন তারা।সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বন্দরকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানির ৯২ শতাংশ খোলা পণ্য আর ৯৮ শতাংশ কন্টেনার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।শ্রমিক–কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চট্টগ্রাম বন্দর আজ সুখ্যাতি লাভ করেছে।প্রতি বছর চট্টগ্রাম বন্দরের মুনাফা বেড়ে চলেছে। যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়ী থাকবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের এক কর্মকর্তা দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, শ্রমিকের উপর নির্ভর করে চট্টগ্রাম বন্দর। শ্রমিক অসন্তোষ করে কোনো কাজ করা সম্ভব না চট্টগ্রাম বন্দরে।তারা মনে করছেন বিদেশি পরিচালনার ফলে তারা বেকার হয়ে পড়বে। বিদেশিরা তাদের রাখবেনা।কিন্তু তাদের ধারণা ভুল। তাদের এখন থেকে দক্ষ করে গড়ে তুললে বর্তমানের চেয়ে বহুগুণ আয়বৃদ্ধি পাবে এবং বর্তমানের চেয় বহুগুণ শ্রমিক নিয়োগ দিবে বিদেশিরা।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার সূত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাথে সরকারের দ্রুত চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দৈনিক আমার সংবাদ জানতে পেরেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, সরকারের যেকোনো যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করি।

বিআরইউ

 

Link copied!