Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর স্বপ্ন বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ইভান চৌধুরী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যায়

ইভান চৌধুরী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যায়

অক্টোবর ১২, ২০২২, ১২:৪৪ পিএম


প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর স্বপ্ন বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তর জনপদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। এটি রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। ৪’শ প্রজাতির প্রায় ৩৬ হাজার তরু-পল্লবে আচ্ছাদিত ছায়া সুনিবিড় ক্যাম্পাস। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য মনোরম। আছে পড়ালেখার চাপ। কমতি নেই শিক্ষার্থীদের আড্ডার। গান বাজনার সঙ্গে পাখ-পাখালির কিচিরমিচির। মাঝে-মধ্যে ক্যাম্পাসে আওয়াজ ভাসে মিছিল স্লোগানের। সবকিছু মিলিয়ে সারাক্ষণ প্রাণোচ্ছল ‘উত্তরের অক্সফোর্ড’ খ্যাত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বুধবার (১২ অক্টোবর) ১৫ বছরে পা রাখলো রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে এ অঞ্চলের তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন উন্নয়নূলক কাজে। এ অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চলছে নানামুখি গবেষণাও।

বিশ্ববিদ্যালয়টি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত
‘মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যতে, নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে, প্রধান বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান আহরণ; লিখিত, মৌখিক ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জন এবং সর্বাধুনিক প্রায়োগিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যুগোপযোগী জ্ঞান বিতরণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য।’ উদ্দেশ্য হলো- ‘উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র। সমাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সংযোগের মাধ্যমে ও সর্বাধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছিলেন উত্তর জনপদের মানুষ। অবশেষে ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রংপুরের মানুষ এ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে গণআন্দোলন শুরু করে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রংপুরে আসেন। রংপুরের সাংবাদিকরা তার কাছে এ দাবিটি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। ওই বছরেরই ১২ অক্টোবর ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক্ষেত্রে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ না করে ২০০১ সালে ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে’র নামে অধিগ্রহণকৃত জমিতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৯ সালে তৎকালীন মহাজোট সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার নামানুসারে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর’ নামকরণ করে।

অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো। এবার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কাঠামো প্রয়োজন। এজন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে নগরীর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। কোনো শিক্ষক ছাড়াই একজন কর্মকর্তা আর কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে তিনটি অনুষদের অধীনে ছয়টি বিভাগে ৩০০ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে এ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।

স্থায়ী ক্যাম্পাস
রংপুর শহরের প্রবেশদ্বার মর্ডান মোড়ের নিকটবর্তী ৭৫ একর জায়গার ওপর ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর’ এর স্থায়ী ক্যাম্পাস অবস্থিত। ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থায়ী ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেন। ২০১২ সালের মধ্যে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২১টি বিভাগ চালু করা হয়। পরে ২০২১ সালে আরেকটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছয়টি অনুষদ, ২২টি বিভাগ, একটি ইনস্টিটিউট, তিনটি আবাসিক হল, চারটি ডরমিটরি, মসজিদ, লাইব্রেরি, প্রশাসনিক ভবন, মেডিকেল সেন্টার, নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভবন রয়েছে। প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক রয়েছেন ১৮৬জন।

সবুজের সমারোহ
স্থায়ী ক্যাম্পাস হলো। কিন্তু পুরো ক্যাম্পাসে কোথায় বসার মতো নেই কোন গাছ, নেই কোন ছায়া। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কয়েকটি দেবদারু, কৃষ্ণচ‚ড়া, বকুলগাছ ছাড়া আর কোনো গাছই ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংস্থার কাছ থেকে ৪’শ প্রজাতির প্রায় ৩৬ হাজার গাছের চারা নিয়ে কয়েকজন বৃক্ষপ্রেমী শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর সহায়তায় ড. তুহিন ওয়াদুদ সেগুলো রোপণ করেন। এখন কিশোর বৃক্ষে শোভিত ক্যাম্পাস। বিশাল এই ক্যাম্পাসজুড়ে অজ¯্র গাছপালায় সুশোভিত সবুজ প্রাঙ্গণ। যেন এক প্রাকৃতিক নিসর্গ। চারিদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে যেন গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ছুটির দিন কিংবা একটু অবসর সময় পেলেই সবুজের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে কালক্ষেপণ করেন না বিশ^বিদ্যালয়ের আশেপাশের দর্শনার্থীরাও।

স্থাপনাসমূহ 
স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে নিহত সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত স্বাধীনতা স্মারক (নির্মণাধীন) এবং শহীদ মিনার (অস্থায়ী)। একটু বেলা গড়াতে গড়াতে দর্শনার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারক, আর শহীদ মিনারের পাদদেশে জমে উঠে বিভিন্ন আসর। কেউ গ্রুপ স্টাডি, কেউ দিচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আবার কেউ গিটার হাতে কেউবা একতারা হাতে মাতিয়ে রেখেছেন নিজ নিজ আসর।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন 
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লেখাপড়া আর আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত সবাই তা নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গণ মাতাতে রয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন অগ্নীস্নান, ভবতরী, টঙের গান, গুনগুন, রনন, উদিচী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি ও ইংলিশ কালচারাল সোসাইটির মতো নামকরা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। আরও রয়েছে বিতার্কিকদের প্রিয় সংগঠন বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটি ডিবেট ফোরাম এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশ ও দেশের বাইরে তুলে ধরতে রয়েছে একমাত্র সাংবাদিক সংগঠন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (বেরোবিসাস)।

আধুনিক পরীক্ষা হল
শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নতুন একটি আধুনিক পরীক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তৎকালীন ট্রেজারার বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এটি নির্মাণ সম্ভব হয়। চলতি বছরের ৬ মার্চ নবনির্মিত পরীক্ষা হলের উদ্বোধন করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। এখানে অত্যান্ত সুশৃঙ্খলভাবে মনোরম পরিবেশে পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করছে প্রত্যেকটি বিভাগ। পরীক্ষার হলটি আরো অত্যাধুনিক করার প্রক্রিয়া চলমান।

যতজন উপাচার্য এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে
এ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন উপাচার্য এসেছেন। প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এম লুৎফর রহমান। প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য এক বছরও পূর্ণ করতে পারেননি। দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে যিনি এসেছিলেন, সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে মেয়াদ পূর্তির একদিন আগে সরকার তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছিল। তৃতীয় উপাচার্য মেয়াদ পূর্ণ করলেও তাঁর চলে যাওয়াটা ততটা সম্মানের ছিল না। চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে এসেছিলেন অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। কলিমউল্লাহর লাগাতার অনুপস্থিতি, সীমাহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি হাস্যরসে পরিনত হয়। রংপুরের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল এ প্রতিষ্ঠানটি এই ভিসির দুর্নীতির কারণে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেছে বলে ধারণা শিক্ষাবিদদের। তার বিদায়টিও ছিলো চরম লজ্জার। পঞ্চম ভিসি হিসেবে এসেছেন অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ। তিনি কোনো রকম বিতর্কে না জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা।

নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী কর্মকর্তা কর্মচারীসহ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। বর্তমানে পরিবহন সেবায় ১০টি বাস, দুটি কোস্টার বাস (শিক্ষকদের ১টি ও কর্মকর্তাদের ১টি) এবং ৫টি রয়েছে মাইক্রোবাস। এ বাসগুলো সাপ্তাহিক ছুটি ব্যাতিত শিক্ষার্থীদের সেবায় প্রতিদিন নিদ্রিষ্ট রুটে এক থেকে দেড় ঘন্টা পর পর যাতায়াত করে। সাতটি রুটে দৈনিক প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী নিয়মিত যাতায়াত করছেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের জন্য রয়েছে আলাদা রুট ও পরিবহন ব্যবস্থা।

সরব ক্রিয়াঙ্গন
খেলাধুলা মানুষের মেধা মনন ও নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত রাখতে সহযোগীতা করে। বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের খেলার আয়োজন করা হয়। যাতে করে শিক্ষার্থীরা মাদক কিংবা জঙ্গীবাদের মতো খারাপ কাজে জড়িয়ে না পড়ে। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা টুর্নামেন্টের আয়োজন সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করতে সহযোগীতা করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া ও শারীরিক শিক্ষা দপ্তর। বর্তমান উপাচার্যের দিক নির্দেশনায় বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন ও বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক খেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার
১৬ আগস্ট ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একটি কক্ষে খন্ডকালীন একজন চিকিৎসকের যোগদানের মাধ্যমে মেডিকেল সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়। এখানে বর্তমানে ৪জন অভিজ্ঞ ডাক্তার (এর মধ্যে একজন ডেন্টাল সার্জন), দুইজন নার্সসহ মোট ১২ জনের একটি মেডিকেল টিম সেবা প্রদান করছেন। শিক্ষার্থীদের মেডিকেল কাডের্র মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও এন্টিবায়োটিক সহ প্রায় ৫০ ধরেণের ঔষধ বিনা মূল্যে প্রদান করা হয়। একটি এম্বুলেন্স রয়েছে যেটি ২৪ ঘন্টায় সার্ভিস প্রদানে নিয়োজিত থাকে। করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট সংকটের সময়ে সারাদেশ লকডাউন হয়ে গেলেও অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ন্যায় মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক সহ সকল স্টাফ স¦শরীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মী ও আনসার সদস্যসহ বিশ^বিদ্যালয়ে অবস্থানরত শিক্ষক, কর্মকর্তা , কর্মচারীগণ ও তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরলসভাবে সেবা প্রদান করে। ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং, ডায়াবেটিকস নির্ণয় পরীক্ষা ও ই.সি.জি করা এবং ডেন্টাল আউটডোর সেবা সহ স্কেলিং ও টেমপোরারি রেস্টোরেশন সেবা প্রদান করা হয় মেডিকেল সেন্টারটিতে। নানা ধকল কাটিয়ে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঝে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে মেডিকেল সেন্টারটি।

মুক্ত জ্ঞান চর্চায় ভূমিকা রাখছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
গ্রন্থাগার হলো নানাবিধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রচেষ্টায় নানাবিধ সমস্যা উত্তরণ করে নতুন রূপে আবর্তন শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিভাগীয় বই ছাড়াও গবেষণা ও চাকুরী সহায়ক ধর্মী বই। গ্রন্থাগারে রয়েছে ই-বুক কর্ণার, জব কর্ণার, বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর অধিকতর জ্ঞান আরোহনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্ণার। সেই সাথে রয়েছে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা রিডিং রুম। যেগুলোর প্রত্যেকটি আধুনিক সাজে সজ্জ্বিত। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই গ্রন্থাগারটি মনোরম পরিবেশে হওয়ায় গ্রন্থাগারটিতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। গ্রন্থাগারটির দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নিরলস পরিশ্রমে উন্নত সেবা পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও প্রত্যেক বিভাগের রয়েছে আলাদা আলাদা প্রায় ২১টি সেমিনার লাইব্রেরী। নিয়মের কিছুটা গ্যারাকল থাকলেও গ্রন্থাগারটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণে অতুলনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের অভিশাপ মুক্তি
চার বছরের স্নাতক শেষ করতে সময় লাগতো পাঁচ থেকে ছয় বছর। এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় দুই বছর। সময়মত সেমিস্টার শেষ না হওয়াতে চাকরির বাজারে হোঁচট খেতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে প্রায়ই লিখতো হতাশার কথা। তবে ২০২১ সালের ১৪ জুন পঞ্চম উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ যোগদানের পর প্রথম অগ্রাধিকার দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের। সেশনজট নিরসনসহ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন ড. হাসিবুর রশীদ। বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসনে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদের দূরদর্শী দিক-নির্দেশনায় ও শিক্ষকদের আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ ও দ্রæততম সময়ে ফলাফল প্রকাশে নজির সৃষ্টি করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেশনজট নিরসনে চার মাসে সেমিস্টার ফাইনাল নেয়ার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ড. হাসিব। উপাচার্যের দুর্দান্ত নেতৃত্বে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেশনজট নামক যে অভিশাপ শিক্ষার্থীদের হতাশায় ফেলছিলো তা নিরসন সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিশাপ দূর হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। এছাড়াও একাডেমিক উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চলমান।

তবে ১৫ বছরেও বিভিন্ন সংকটে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যার মধ্যে তীব্র সংকটে রয়েছে-আবাসন সংকট। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে প্রায় ১০ হাজার। পক্ষান্তরে আবাসিক হল রয়েছে তিনটি। আর এই তিন আবাসিক হলে আসন সংখ্যা রয়েছে মাত্র ৯৩৭টি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে সর্বাধিক আসন ৩৫৫টি ও শহীদ মুখতার ইলাহী হলে ২৪০টি। আর মেয়েদের জন্য একমাত্র শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলে মাত্র ৩৪২টি আসন রয়েছে। যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় নগণ্য। ফলে শিক্ষার্থীদের একাংশকে গাদাগাদি করে হলরুমে এবং সিংহভাগ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী এলাকার মেসগুলোতে থাকতে হয়। এ সংকট নিরসনে দ্রুত আবাসিক হল নির্মাণে গুরুত্ব না দিলে সমস্যা আরো প্রকট হবে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে প্রশাসন বলছে শিক্ষার্থীদের সমস্যা প্রাধান্য দিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে।

শ্রেণিকক্ষ সংকট
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৬টি অনুষদ, ১টি ইনস্টটিউিট, ২২টি বিভাগ থাকলেও সেই তুলনায় নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ। প্রয়োজনের তুলনায় শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা অপ্রতুল। বর্তমানে প্রতিটি বিভাগের প্রায় ৫টি করে ব্যাচ রয়েছে। এর বিপরীতে ক্লাসরুম রয়েছে কোন বিভাগের একটি আবার কোন বিভাগের দুইটি করে। যার ফলে এক ব্যাচের ক্লাস শেষ হতে না হতেই অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ওই ক্লাসরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। এতে ক্লাস রুমে অবস্থানরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনযোগে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি অস্বস্তিতে পড়তে হয় দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদেরও। তবে, এ সংকট সমাধানে একাডেমিক ভবন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। খুব শীঘ্রই সম্প্রসারণ কাজ শুরু হবে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

শিক্ষক সংকটে ব্যাহত শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। কিন্তু পাঠদানের জন্য শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। এর মধ্যে প্রায় ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদের শিক্ষা ছুটিতে। বাকি ১৭৬ জনের অনেকেই বিভাগীয় প্রধান, হলের প্রভোস্টসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু থাকায় বিভাগের একজন শিক্ষককেই নিতে হচ্ছে ১০-১২টি কোর্স। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫৪। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রকাশিত ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বলছে শিক্ষক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে বার বার ইউজিসির কাছে পদ চেয়েও পাচ্ছে না। ইউজিসি আন্তরিক হলেই এটি সমাধান সম্ভব।

উপেক্ষিত বেগম রোকেয়া
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামে নির্মিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপেক্ষিত মহীয়সী এই নারী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরেও ক্যাম্পাসে বেগম রোকেয়ার কোনো প্রতিকৃতি বা ম্যুরাল স্থাপন করা হয়নি। রোকেয়াকে জানতে ও তার দর্শন চর্চায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন পেলেও দীর্ঘদিনেও চালু হয়নি রোকেয়া স্টাডিজ। নেই রোকেয়া বিষয়ক চর্চারও কোনো সুব্যবস্থা। রংপুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার দাবি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, পায়রাবন্দের ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা করেছি। সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

ফটক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক নির্মাণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও রংপুরের স্থানীয়রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে চারটি প্রবেশপথ রয়েছে। তবে আজও নির্দিষ্ট করা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটক। প্রতিষ্ঠার এক ১৫মত বছরে এসেও নির্মাণ করা হয়নি দৃষ্টিনন্দন ফটক। সাবেক ভিসি তার দুর্নীতি ঢাকতে প্রধান ফটকের সাদামাটা নকশা  প্রকাশ করলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরে সমালোচনার মুখে নকশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান ভিসি দৃষ্টিনন্দন চুড়ান্ত নকশা প্রণয়ন এবং চলতি বছরের ৪ জুলাই প্রধান ফটক নির্মাণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান।

উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা
২০১২ সালের পর আর কোন অবকাঠামো নির্মাণ হয়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের দুটি ভবন শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ওয়াজেদ রিসার্চ ইন্সটিটিউট এখনো নির্মাণাধীন। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি কাজের উদ্বোধন হলেও এখন পর্যন্ত অসম্পন্ন। এমনকি স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে আছে। এখনো অস্থায়ীভাবে নির্মিত আছে শহীদ মিনার। এসব প্রকল্পে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. কলিমউল্লাহর ও তার সহযোগীদের সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। বর্তমান প্রশাসন এটি পুনরায় নির্মাণের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। দিনশেষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখেন তারা এখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবেন। সবুজের এই বিশাল সমারোহ আর ক্যাম্পাসের বড় বড় ভবন, সবমিলিয়ে পাখির চোখে এই ক্যাম্পাসটি যেন দাঁড়িয়ে থাকা একটি জ্ঞান বৃক্ষের মতো। প্রতিষ্ঠার ১৫তম বছরে এসে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো ছড়িয়ে পড়ুক দিক দিগন্তে- এটিই প্রত্যাশা।

এআই

Link copied!