Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫,

দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সর্বজনীন করার পরিকল্পনা

আমার সংবাদ ডেস্ক

আমার সংবাদ ডেস্ক

জানুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১১:০৪ এএম


দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সর্বজনীন করার পরিকল্পনা

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি ভাবছে প্রাথমিকে যাতে পাবলিক পরীক্ষার মতো কোনো পরীক্ষা চালু না হয় সেই সুপারিশ করার। এ ছাড়া ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সর্বজনীন করা এবং এই স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে একই মন্ত্রণালয় বা একই তত্ত্বাবধানে রাখার পরামর্শ যেন দিতে পারে সেটিও এ কমিটির পরিকল্পনা ।

পাশাপাশি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা, শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানো, দুর্বল বা পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যেই পৃথক ব্যবস্থা রাখা, শেখার দিক বিবেচনা করে বিদ্যালয়গুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ—এই তিন শ্রেণিতে গ্রেডিং করাসহ একগুচ্ছ সুপারিশের চিন্তাভাবনা করছে পরামর্শক কমিটি।

কমিটি সূত্রে  জানা যায়, তারা এ মাসের মধ্যে সরকারের কাছে  সম্ভাব্য এসব সুপারিশ সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেবে।

বর্তমানে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩০টি। শিক্ষার্থী প্রায় দুই কোটি। মোট বিদ্যালয়ের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৭টি, শিক্ষক প্রায় ৪ লাখ। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষা বলা হয়। তবে প্রায় ৭০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কমিটি প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।

কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তারা তিন মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করেছে। দেশের ১০টি উপজেলায় সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেখানকার বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছে।

পরামর্শক কমিটি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে মূল্যায়ন করেছে। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গণিতের দক্ষতা যাচাই করা হয় এই মূল্যায়নে। এতে কমিটি দেখেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শ্রেণি উপযোগী যতটা শেখার কথা, তা পারছে না।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জন কীভাবে হবে, সেটির ওপর জোর দিয়েছে পরামর্শক কমিটি। তাদের সম্ভাব্য সুপারিশের মধ্যে থাকছে, দুর্বল বা পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বিশেষ যত্ন নিয়ে শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যে নির্ধারিত শ্রেণি সময়ের আগে-পরে একটি ব্যবস্থা করা। প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে অন্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে কাজটি করতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনা দিতে হবে, যা সরকারকে বাজেট আকারে দিতে হবে।

স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা, শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানো, দুর্বল বা পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যেই পৃথক ব্যবস্থা রাখা, শেখার দিক বিবেচনা করে বিদ্যালয়গুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ—এই তিন শ্রেণিতে গ্রেডিং করাসহ একগুচ্ছ সুপারিশের চিন্তাভাবনা করছে পরামর্শক কমিটি।
একগুচ্ছ সুপারিশ

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ২০০৯ সালে চালু হয়েছিল, কিন্তু ২০২০ সালে করোনার পর থেকে তা আর হয়নি। বন্ধ হয়েছিল প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। কিন্তু মাঝে ২০২২ সালে হঠাৎই আবার এই বৃত্তি পরীক্ষা চালু হয়। কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। গত বছর তা হয়নি। তবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ এখনো তা বাতিল করেনি। প্রতিবছর বৃত্তির টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়।

তবে পরামর্শক কমিটি প্রাথমিকে পাবলিক পরীক্ষার মতো কোনো পরীক্ষা যাতে চালু করা না হয়, সেই সুপারিশ করার কথা ভাবছে। তবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক ও প্রান্তিক মূল্যায়ন (প্রথম, দ্বিতীয় ও বার্ষিক পরীক্ষা) রাখার পক্ষে তারা। পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (এনএসএ) আদলে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করবে কমিটি।

কমিটির পর্যবেক্ষণে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন হয়। দাবিদাওয়ার বিষয়টি সমাধান হওয়া দরকার। শিক্ষকেরা যাতে ঠিকমতো নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সে জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে কমিটি মনে করে, শিক্ষকদের বেতনকাঠামো উন্নত হওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের বাস্তব পরিস্থিতিও বিবেচনা রাখতে হবে।

আর দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ হিসেবে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো ও আলাদাভাবে নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলবে কমিটি। তারা বলছে, শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের পথরেখা থাকতে হবে। কারণ, বর্তমানে দেখা যায়, অনেক শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হিসেবেই সারা জীবন চাকরি করে অবসরে যান। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণব্যবস্থা বাস্তবসম্মত করা ও শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করবে কমিটি।

কমিটির মত হলো, বিদ্যালয়কাঠামো এখনকার মতো রেখে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন করা। প্রথমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত করা। এরপর ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশের কথা তাদের ভাবনায় আছে।

বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের সংকট সব সময়ই থাকে। এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ‘প্যারা শিক্ষক’ (নির্ধারিত শিক্ষকের বাইরে আলাদা কয়েকজন সহশিক্ষক রাখার ব্যবস্থা করা) নিয়োগ করা যেতে পারে বলে মনে করে কমিটি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) সঙ্গে মিলে এ কাজ করা যেতে পারে বলে মনে করে কমিটি। এ ছাড়া দুর্গম বা পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষকদের থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা এবং পার্বত্য এলাকায় আবাসিক বিদ্যালয় বাড়ানোর পক্ষে তারা।

কমিটির মত হলো, বিদ্যালয়কাঠামো এখনকার মতো রেখে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন করা। প্রথমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত করা। এরপর ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশের কথা তাদের ভাবনায় আছে। এ ক্ষেত্রে সময় অনুযায়ী পরিকল্পনা করে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ সুপারিশের পেছনে কমিটির যুক্তি হলো, এটি হলে সব শিক্ষার্থীর জন্য দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব।

উল্লেখ্য, গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সর্বজনীন শিক্ষা আইন করা হয়েছিল।

পরামর্শক কমিটি প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘সত্যিকারের বিকেন্দ্রীকরণ’ করার পক্ষে। তারা বলছে, দীর্ঘমেয়াদি এ সুপারিশের ক্ষেত্রে ‘জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা যেতে পারে। আর প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি শুধুই উপজেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সংযুক্তি ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে কমিটি।

বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা যেভাবে হচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। পরামর্শক কমিটি এ বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ এনজিওদের সহযোগিতায় একটি ভালো মডেল চালু করার কথা বলছে। এ ছাড়া মিড‍–ডে মিল সর্বজনীন (সব বিদ্যালয় সব শিক্ষার্থীর জন্য) করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে পরামর্শক কমিটি।

জানতে চাইলে পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তারা মূলত শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও তাদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে যাচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা অর্জনের মূল শক্তি হলো শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানোর বিষয়ে তারা সহানুভূতিশীল হয়ে সুপারিশ করবেন। তারা আশা করছেন, যেসব সুপারিশ করা হবে, তা বাস্তবায়নে পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি-৫) সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা এবং আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা হবে।

জানতে চাইলে পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তারা মূলত শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও তাদের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে যাচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা অর্জনের মূল শক্তি হলো শিক্ষক।

বিআরইউ

Link copied!