Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,

‘বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে লাশের রাজনীতি হয়’

মুরাদুল মুস্তাকীম মুরাদ, কুবি

মুরাদুল মুস্তাকীম মুরাদ, কুবি

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫, ০২:০০ পিএম


‘বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে লাশের রাজনীতি হয়’

বিশ্বের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার মান নিয়েই প্রশ্ন উঠছে বারবার। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে ধরা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতিকে। 

সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির প্রভাব নিয়ে আমার সংবাদের সাথে কথা হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মুতাসিম বিল্লাহর সঙ্গে।

আমার সংবাদ: আপনার দৃষ্টিতে ছাত্ররাজনীতির সুফল কারা ভোগ করে? 

মুতাসিম বিল্লাহ : আমার মতে ছাত্ররাজনীতির সুফল শিক্ষার্থীরা ভোগ করেন না। এটি ভোগ করেন সিন্ডিকেটের নির্দিষ্ট কিছু লোক। এবং যারা ভোগ করেন তারা তাদের সন্তানদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠান না। মেক্সিমামই দেশের বাহিরে পাঠান। আমাদের যে ছাত্ররাজনীতির কাঠামো এখানে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ভয়েস রেইজ করতে দেখলেও তারা অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হোন। যদিও ছাত্ররাজনীতি কিছু সুফল আমরা দেখি  আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান এর ক্ষেত্রে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির অধিকাংশ সুফল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা সিন্ডিকেট চক্রকে ভোগ করতে দেখি। এখানে অনেক ছাত্ররা জানেও না তারা আসলে কার জন্য রাজনীতি করে। বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে লাশের রাজনীতি হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও খালেদ সাইফুল্লাহ নামে এক শিক্ষার্থী রাজনীতির বলি হয়েছে। নিশ্চয়ই তার বাবা-মা রাজনীতি করার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান নাই।

আমার সংবাদ: ছাত্ররাজনীতির ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাব পড়ে কিনা ?

মুতাসিম বিল্লাহ : আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক জায়গায় ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা দেখি খুবই নগণ্য। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেগেটিভ প্রভাব ফেলছে। সেটার ফলাফল আমরা ২৪ এর আন্দোলনে দেখেছি। এর আগেও দেখেছি। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন যারা থাকে তাদেরই ছাত্রসংগঠনগুলো লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় রাখে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে। শুধু শিক্ষার্থী না শিক্ষকদেরও কণ্ঠরোধ করে৷ তবে ছাত্ররাজনীতিতে শিক্ষার্থীদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষকেরও ভূমিকা থাকে। পাশাপাশি এদেরকে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করানোর জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন পার্টির বেশি ভূমিকা থাকে।

আমার সংবাদ: ছাত্ররাজনীতির সুবিধাভোগী কারা?

মুতাসিম বিল্লাহ : আমাদের বাংলাদেশের একটা রাষ্ট্র কাঠামোটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর উপর দাঁড়ানো। সেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী ঔপন্যাসিক সুবিধায় পুষ্ট যারা তারাই আসলে ছাত্ররাজনীতির মূল সুবিধাভোগী। এখানে আমি নির্দিষ্ট কোনো দলের কথা বলবো না। আমাদের কাঠামোটি এমন যে এই কাঠামোতে একজন আরেকজনকে শোষণ করে, সিস্টেমটাকে ধরে রাখতে তারা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীকে সুবিধা দেয়, তাদের দ্বারা বাকিদের নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সব থেকে বেশি সুবিধাভোগী থাকে। দোরেন একমোগলু ও কেএম রবিনসন তাদের বই হোয়াই নেশন ফেইল এ এবং আরেকটি বই দ্যা ডিরেক্টরল্যান্ড এ সুবিধাভোগীদের চরিত্র উন্মোচন করেছেন।  

আমার সংবাদ: ছাত্ররাজনীতিত ফলে শিক্ষকদের উপর কেমন প্রভাব পড়ে?

মুতাসিম বিল্লাহ : ছাত্ররাজনীতির ফলে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুইজনের উপরই প্রভাব পড়ে। ছাত্ররাজনীতির ফলে শিক্ষকেরা অনেকসময় কোণঠাসা থাকেন। তাঁরা কথা বলতে ভয় পান। ছাত্র সংগঠনগুলো যদি কোনো সরকারি দলের সংগঠনের জায়গায় পৌঁছে যান তখন সে জায়গাটায় বাকি শিক্ষকেরা এক ধরনের সেন্সরশিপ ফিল করেন। যেকোনো বিষয়ে বলার ক্ষেত্রে  আফটার ইফেক্ট হিসেব করে কথা বলেন। 
একজন শিক্ষককে গবেষক হয়ে উঠতে গেলে তার সহযোগী দরকার। শিক্ষার্থী যদি পাঠের চেয়ে মাঠে পড়ে থাকতে পছন্দ করেন, তাহলে এটি যেমন শিক্ষককে গবেষণার সংস্কৃতি তৈরিতে বেগ পোহাতে হয়, তেমনি ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যে শিক্ষকের হাতে থাকে তার কাছে বাকি গবেষক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কোণঠাসা অবস্থায় থাকতে হয়। এতে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।

আমার সংবাদ: ছাত্ররাজনীতিত ফলে শিক্ষার্থীদের উপর কেমন প্রভাব পড়ে?

মুতাসিম বিল্লাহ : আমরা যদি বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখি সেখানে কি ছাত্ররাজনীতি আছে? এ কারণে কি সেখানি ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় না? সেখানে কি পড়াশোনা হয় না? কিন্তু আমরা যদি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে দেখি তাহলে দেখতে পাব রাজনীতির সাথে শিক্ষার্থীরা বেশি জড়িত কিন্তু সুবিধাগুলো তারা পায় না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিন্তু কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় সেটি ভালোভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে যে-সব শিক্ষার্থী জড়িত তাদের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারে না। বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে লাশের রাজনীতিটা হয়। যতগুলো ছাত্র হত্যা হয়েছে দেখা যাবে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলগুলোর ভাগাভাগির কারণে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমরা যদি দেখি অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় এখন মত প্রকাশ করতে পারছে। এর কারণ হচ্ছে তারা অনুভব করছেন যে এখনই কেউ তাকে মত প্রকাশ করার জন্য ধরবেন না। কিন্তু অন্যান্য সময়ে দেখেছি যে সরকারই ক্ষমতায় আসেন তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর কারণে বাকি শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারেন না।

আমার সংবাদ: স্বাধীনতার পর থেকে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতির এমন অবস্থা চলছে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মুতাসিম বিল্লাহ : বুয়েটের বা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি তাহলে দেখবো সেখানকার শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায়। আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গবেষণায় ভালো করছে। সুস্থ সংস্কৃতি থাকায় গবেষণা র‍্যাংকিংয়ে তারা ভালো করছে। এর বড় কারণ হল সেখানে ছাত্ররাজনীতি না থাকা। কেউ যদি রাজনীতি পছন্দ করেন তাহলে তা তার ব্যক্তিগত। লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতির বদলে প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ থাকতে পারে। যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলবেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলবেন। আমরা দেখি লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে অপরাধের একটা সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ নেতারা তাদের কর্মীদের ধরে রাখার জন্য মাদকের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সংস্কৃতির হাতেখড়ি দেন। এই চর্চা কর্মজীবনেও থেকে যায়। ছাত্র নেতাদের রাজনীতির খরচ পরিচালনায় স্বচ্ছ আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় তারা অল্প বয়সে অনৈতিক পথে পা বাড়ান। শিক্ষাঙ্গনে যদি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদ চালু করা যায়, শিক্ষার্থীদের সেবার মানসিকতা নিয়ে সংসদে আসার সংস্কৃতি চালু করা যায় তাহলে এটার সুফল সবাই ভোগ করবে। হয়ত এটা বাংলাদেশের কোনো দলই চাইবে না।
কারণ পরবর্তী তাদের অনুসারী কমে যাওয়ার একটা ভয় রয়েছে৷ ১৬ বছর একটা দল বাহিরে ছিল আরেক আরেকটি বাহিরে থাকবে৷ এভাবে কিন্তু কারোরই মুক্তি মিলবে না। এর পাশাপাশি সরকারকে শিক্ষাখাতে অনেক বেশি বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে।  প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানোর ও শেখার মানসিকতা সম্পন্ন শিক্ষকদের এই পেশায় আসার সুযোগ করে দেওয়া দরকার এবং এমন সুযোগ সুবিধা থাকা উচিত যেন নির্দ্বিধায় সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসেন৷ এটা নিশ্চিত করা গেলেই আমরা একটা ভালো সংস্কৃতি চালু করতে পারবো৷

আমার সংবাদ: রাজনীতির বদলে শিক্ষকরা কীভাবে গবেষণামুখী হতে পারে?  

মুতাসিম বিল্লাহ : শুধু বাংলাদেশের শিক্ষকদেরই দেখবেন না, বাংলাদেশের মানুষের দেখবেন যে নেতার পিছনে হাঁটার একটা মানসিকতা থাকে৷ এখানে রাষ্ট্র যদি নিশ্চয়তা দেয় যে অন্য, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা দিবে তাহলে আগামীকাল থেকে অনেক দলের অনুসারীদের খুঁজে পাবেন না৷ আমাদের শিক্ষকদের পদন্নোতির একটা বিষয় রয়েছে। পদন্নোতির আইন এতটা সহজ না। এখানে নেতার কর্তৃত্বের একটা বিষয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই দিকটা দুইভাগ দেখার সুযোগ রয়েছে। বিগত উপাচার্যদের আমলে দেখেছি একই আইন কারো উপর একভাবে আরোপ হয়েছে অন্যজনের উপর আরেকভাবে আরোপ হয়েছে। এখানে শিক্ষকদের একটা পক্ষ বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়, আরেক দল ভয়ের জায়গা থেকে জড়িয়ে যায় যে আমি যেন বৈষম্যের শিকার না হই৷ একটা দলের সাথে যুক্ত থাকলে তারা আমার দাবিদাওয়া তুলে ধরবে৷ অনেকটা বাধ্য হয়েই যান আরকি৷ আবার একটা দল আছে তারা কারো সাথে যান না৷ তাদের কথা কেউ জানেও না।

আমার সংবাদ: রাজনীতির দুষ্ট চক্র থেকে একজন শিক্ষার্থীকে ফিরে আনার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হতে পারে?

মুতাসিম বিল্লাহ : আমি মনে করি একজন শিক্ষক তার প্যারাডাইম শিফটের সুযোগ আছে। যেমন ‍‍`হীরক রাজার দেশের সিনেমায় দেখি তাহলে দেখবো একটা স্বৈরাচারের পতনে একজন শিক্ষক কতটা ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা কিন্তু ২০২৪ সালেও দেখেছি। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ইভেন আমি নিজেও এই জায়গাতে কথা বলার চেষ্টা করেছি। একজন শিক্ষক যদি তার জ্ঞানের জায়গা থেকে সত্যের পক্ষে তার জ্ঞানের গভীরতা তার যদি না দাঁড়াতে সাহস করেন তাহলে বাকি পৃথিবীর লোকেরা কীভাবে দাঁড়াবে। আমার মনে হয় আমরা নিজেদের সাথে, আমাদের জ্ঞানের সাথে প্রতারণা করি৷ আমরা তো জেনেই এসেছি এই জায়গাতে সব সুযোগ সুবিধা নেই৷ আমরা যদি ইথিকসের জায়গায় থেকে দাঁড়াতে পারি তাহলে এটিই হবে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রেরণা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলো ছড়ানোর জন্য একজন শিক্ষকই ভূমিকা রাখতে পারবেন। একজন শিক্ষকের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও তাঁর আদর্শ জীবন অনেক শিক্ষার্থীকে নৈতিক পথে চলতে, আত্মসম্মানবোধ জাগাতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে।

বিআরইউ 
 

Link copied!