সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩, ০২:৪১ পিএম
অটোমান বা ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী শাসক আরতুগ্রুলকে নিয়ে তুরস্কের ধারাবাহিক নাটক বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে নিজস্ব ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রচার হয়েছে। এই টিভি সিরিজ বিভিন্ন দেশে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মুখেও ফুটেছে এর প্রশংসা।
আরতুগ্রুল সিরিজের ভক্তদের মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন তিনি ওই ধারাবাহিকে দেখানো `ইসলামী সভ্যতার` প্রশংসা করেছিলেন।
খান বলেছেন, `আরতুগ্রুলের মতো বহুল প্রচারিত সিরিজে কোন অশ্লীলতা নেই। তরুণরা টিভির সামনে বসে ইসলামী নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিখতে পারবে।`
অটোমান ঐতিহ্য অনুসারে আরতুগ্রুল ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা। এর বাইরে তার সম্পর্কে বাস্তব যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা নগণ্য।
এই সাম্রাজ্য বহু শতাব্দী ধরে বিশ্বের একটি বড় অংশ শাসন করেছে। কিন্তু তাদের সূচনা কিভাবে হয়েছিল সে তথ্য ইতিহাসের পাতা থেকে অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
উসমানীয় ঐতিহ্য ছাড়াও ইতিহাসের বইগুলোতে ওই সময়ের দু`টি সুনির্দিষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেছে। যার মধ্যে রয়েছে একটি মুদ্রা এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের একজন ইতিহাসবিদের লেখা একটি নিবন্ধ।
সেই সাথে পাওয়া গেছে উসমানের একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা। যা এই নিবন্ধের শেষ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেসব নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি হলো, উসমান বর্তমানে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় বসবাসকারী একটি তুর্কি যাযাবর উপজাতির সদস্য ছিলেন। তার সরকার ছিল ছোট আনাতোলিয়ান সরকারগুলোর মধ্যে একটি, যাদের ক্ষমতায় খুব একটা পার্থক্য ছিল না।
প্রশ্ন জাগে যে উসমান বা তার পিতা এমন কী করেছিলেন যার কারণে এই পরিবারের শাসন একটি গোত্র থেকে ছোট রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। আনাতোলিয়ার একটি বড় সাম্রাজ্য তিনটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপর একটি খিলাফতে পরিণত হয়।
অটোমান সাম্রাজ্য ১৪০০ শতকের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং যার পতন ঘটে ২০ শতকে এসে। একই পরিবারের ৩৭ জন সুলতান সিংহাসনে বসেন। একজন ইতিহাসবিদের মতে, একটি পরিবারের এত দীর্ঘ সময় নিরবচ্ছিন্ন শাসন জারি রাখা অলৌকিক ঘটনার মতো।
ইতিহাসবিদ ক্যারোলাইন ফিঙ্কেল তার `অটোমান`স ড্রিম: দ্য স্টোরি অফ দ্য অটোমান এমপায়ার` বইতে লিখেছেন যে `অটোমানদের সাফল্যের কারণ যাই হোক না কেন, আনাতোলিয়ায় (বর্তমান তুরস্কের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চল) তাদের সাফল্য ছিল।` দুই শতাব্দী ধরে প্রতিবেশীদের সাথে তাদের বিরোধ তীব্র ছিল।
আরতুগ্রুল সম্পর্কে অটোমান ঐতিহ্য
ইতিহাসবিদ স্ট্যানফোর্ড জে শ’ তার `হিস্ট্রি অব দ্য অটোমান এমপায়ার অ্যান্ড মডার্ন টার্কি` বইতে এই ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেছেন যে `ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের ইতিহাস সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল।`
`তবে ওই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানার উৎস ছিল সীমিত। এছাড়া পরবর্তীকালে অটোমান ঐতিহ্য নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বৈপরীত্য থাকায় সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কঠিন।`
এই বিখ্যাত ঐতিহ্যের বর্ণনা দিয়ে গিয়ে তিনি লিখেছেন, অটোমানদের পূর্বপুরুষ আমজাদ সালমান শাহ, যিনি ছিলেন সেই সময়কার কাই উপজাতির প্রধান। ১২০০ শতকের শেষের দিকে উত্তর ইরানের একটি এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন।
ঐতিহ্য অনুসারে, এই উপজাতি, অন্যান্য অনেক তুর্কি উপজাতির মতোই, মঙ্গলদের আক্রমণের মুখে দাসত্ব ও ধ্বংস থেকে বাঁচতে নতুন অঞ্চলে পালিয়ে যায়।
জে শ`- এর মতে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে সালমান শাহ সিরিয়ায় প্রবেশের সময় ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদীতে ডুবে মারা যান। এরপর তার দুই ছেলেই ফিরে যান।
আরতুগ্রুল যখন পশ্চিম দিকে তার যাত্রা শুরু করেন এবং আনাতোলিয়ান অঞ্চলে প্রবেশ করেন, সেখানকার সেলজুক শাসকরা তখন তাকে তার সাহায্যের বিনিময়ে আনাতোলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে জমি দেন।
জে শ`-এর বইতে লিপিবদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে, আরতুগ্রুল ১২৮০ সালে মারা যান এবং উপজাতির নেতৃত্ব তার ছেলে উসমানের হাতে চলে যায়।
ফিঙ্কেল লিখেছেন যে, অটোমান ঐতিহ্য অনুসারে, আরতুগ্রুল নামে একজন উপজাতি প্রধান (সর্দার) উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ায় এসে সেলজুক এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন।
এই ঐতিহ্য অনুসারে, সেলজুকের সুলতান সেখানকার সুগাতা নামক অঞ্চলে আরতুগ্রুলকে কিছু জায়গা দান করেন। কিন্তু উসমানের সাথে আরতুগ্রুলের সম্পর্ক কী ছিল?
অজানা তারিখের একটি মুদ্রা
ইতিহাসবিদ ফিঙ্কেল লিখেছেন, এটি অটোমান আমলের একটি মাত্র সংগৃহীত মুদ্রা, এটা যদি সত্যি ওই সময়কার মুদ্রা হয়, তাহলে এটি প্রমাণ করে যে আরতুগ্রুল প্রকৃতপক্ষে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ওই মুদ্রায় লেখা আছে `আরতুগ্রুলের ছেলে উসমানের জন্য জারিকৃত মুদ্রা`।
ফিঙ্কেল আরো লিখেছেন যে উসমানের নিজের নামে মুদ্রা জারি করা প্রমাণ করে যে তিনি এই সময়ে কেবল একজন উপজাতীয় প্রধান ছিলেন না। বরং সেলজুক এবং মঙ্গল সাম্রাজ্যের ছায়ার বাইরেও তিনি নিজেকে আনাতোলিয়ায় একজন স্বাধীন আমির বা নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন।
ফিঙ্কেল লিখেছেন যে, ইতিহাসে অটোমানদের ব্যাপারে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে ১৩০০ সালের দিকে। তৎকালীন এক বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ লিখেছেন যে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী উসমান নামে এক ব্যক্তির সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়।
বাফিয়াসের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধটি কনস্টান্টিনোপলের (ইস্তাম্বুল) কাছে সংঘটিত হয়েছিল এবং বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী খুব খারাপভাবে পরাজিত হয়েছিল।
কিন্তু অটোমানদের তখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মতো শক্তিশালী হতে আরো সময়ের প্রয়োজন ছিল। যখন এমনটা ঘটে অর্থাৎ অটোমানরা প্রবল শক্তিতে আবির্ভূত হয়, তখন কথা ওঠে যে কিভাবে একটি নাম না জানা পরিবার হঠাৎ করে এতদূর এসে এতটা ক্ষমতাধর হয়ে উঠল।
ইতিহাসবিদরা বলেছেন যে অটোমানরা ভাগ্যবান যে তাদের অঞ্চলটি কনস্টান্টিনোপলের কাছাকাছি ছিল। যার কারণে কখনো কখনো সফল বিজয় পেলে বড় পুরস্কার পাওয়া সুনিশ্চিত ছিল। সূত্র : বিবিসি
এইচআর