প্রিন্ট সংস্করণ
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৯, ০৬:১৪ এএম
ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অনুধাবন করেছিলেন, অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। আর প্রাচীন লেখক মার্কাস টুলিয়াস সিসারো বইকে নিয়ে বলে গেছেন বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মা ছাড়া দেহের মতো। বই ঘুমন্ত মন ও চেতনাকে জেগে তোলার জিয়নকাঠি। বইয়ের পাতায় পাতায় চোখ রেখেই আমরা স্বপ্ন দেখি, কল্পনা করি অন্য এক ভুবনের। যে ভুবন আমাদের আগামী প্রজন্মকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। বিশ্বে এমনো বই আছে যা কি না জীবনে একবার হলে পড়তে হয়। এবার এমনই সব বই নিয়ে লিখেছেন - জিয়া উল ইসলাম
নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প : আনা কারেনিনা
রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসটি ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্বে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বই হিসেবে এটি প্রকাশ পায় ১৮৭৮ সালে। এই উপন্যাসটি তলস্তয়ের প্রথম উপন্যাস বলে মনে করা হয়। দস্তয়ভস্কি তাঁর এই লেখাকে ‘শিল্পের নিখুঁত প্রকাশ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভøাদিমির নাবোকভও লেখাটিকে ‘তলস্তয় রীতির নিখুঁত জাদু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, আর উইলিয়াম ফকনার তো বলেছেন, ‘সেরা উপন্যাস’। আনা কারেনিনা উপন্যাসটিতে সে সময়ের বাস্তবতা আর পারিবারিক জীবনে অবৈধ সম্পর্কের গল্প প্রকাশ পেয়েছে। আন্না কারেনিনা বিবাহ সম্পর্কের বন্ধনে অটুট মনোবলের থাকলেও এক সময় সে প্রেমে পড়ে যায়। আন্না কারেনিনা উপন্যাসটি এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের গল্প বলা যায় । টাইমস ম্যাগাজিন জরিপে সেরা দশ বইয়ের প্রথমে আছে এই উপন্যাস বইটি।
ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী : মাদাম বোভারি
এটি পরকীয়া প্রেমকে ঘিরে লেখা। নিজ কন্যাসন্তান বার্থকে আর স্বামীকে ভুলে নায়িকা এম্মা বোভারি মেতে ওঠে ত্রিভুজ প্রেমে। তার এক প্রেমিক মধ্যবয়সী সাথে। গল্পটি এক চিকিৎসকের স্ত্রী, এমা বোভারিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, যিনি গতানুগতিক আর শূন্য জীবন থেকে পালাতে পরকীয়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত ‘মাদাম বোভারি’ ফরাসি লেখক গুস্তাভে ফ্লবার্টের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৮৫৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লা রেভ্যু দ্য প্যারিসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এসময় আইন কর্মকর্তারা অশ্লীলতার অভিযোগ তুলেছিলেন এর বিরুদ্ধে। পরের বছর জানুয়ারি মাসে এ নিয়ে মামলার ফলে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে যায় উপন্যাসটি। রায়ে ফ্লবার্ট নির্দোষ বলে প্রমাণিত হওয়ার পর বইটি প্রকাশ পায় এবং সে বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে সেরা বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই উপন্যাসটি ফ্লবার্টের একটি মাস্টারপিস বলে মনে করেন সমালোচকেরা। এই বইটি টাইমের সেরা বই তালিকায় রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।
ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের সাক্ষী ওয়ার অ্যান্ড পিস
সারা দুনিয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে এই উপন্যাসের বিশেষ গুরুত্ব আছে লেখক তলস্তয়ের এই উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্যতম কাজ। এটি তাঁর নিখুঁত সাহিত্যগুলোর মধ্যে সেরা বলেও মনে করা হয়। ওয়ার এন্ড পিস উপন্যাসে ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের নির্মম ঘটনা, সমাজ ও সময় ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে। এই উপন্যাসে পাঁচটি অভিজাত পরিবারের বয়ানের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাশিয়া আক্রমণের ঘটনা এবং নেপোলিয়ান যুগে সিজারিক সমাজের ওপর প্রভাব আলোচিত হয়েছে। উপন্যাসটি বই আকারে ১৮৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। নিউজউইক ২০০৯ সালে বইটিকে সেরা ১০০ বইয়ের তালিকায় সবার ওপরে রাখে। ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’কে বিশ্বসাহিত্যের সেরা ১০ বইয়ের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রাখে।সৎ মেয়ের সাথে : প্রেমের কাহিনী ললিতারাশিয়ান-আমেরিকান লেখক ভ্লাদিমির নাবোকভের ভুবনবিখ্যাত উপন্যাস ললিতা আছে তালিকার চার নম্বরে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাম্বার্ট একজন লেখক যে কিনা তার বারো বছর বয়সী সৎ মেয়ে ললিতার প্রেমে পড়ে। বিধবা চারলতে হায, হাম্বার্টকে স্বামী হিসেবে পেলেও এক সময় ললিতার সঙ্গে হাম্বার্টের সম্পর্ক তার চোখে ধরা পড়ে। চারলতে হায ক্ষোভে গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। অন্যদিকে এই কথা গোপন রেখে হাম্বার্ট ললিতার যৌন সংসর্গ পেতে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এমনই এক নিষিদ্ধ গল্প আছে ললিতাতে। উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হয় এবং প্যারিসে অলিম্পিয়া প্রেস ১৯৫৫ সালে এটি প্রকাশ করে। পরে লেখক নিজেই এটি রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং নিউইয়র্কে ফায়েন্দ্র পাবলিশার্স ১৯৬৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশ করে। প্রকাশের পর খুব দ্রুতই সমালোচকদের নজর কাড়ে ললিতা। বর্তমানে এটি বিংশ শতাব্দির সেরা সাহিত্যকর্মের একটি বলে বিবেচিত হয়। বইটিকে উপজীব্য করে ১৯৬২ সালে এবং ১৯৯৭ সালে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
বর্ণবাদ নিয়ে বই : দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন
মার্ক টোয়েনের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ ১৮৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যে এবং ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়। আমেরিকান সাহিত্যের সেরা কাজগুলোর একটি বলে মনে করা হয় এই বইটিকে। গল্পের চরিত্র হাকলবেরির বয়ানে ঘটনার বয়ান হয়েছে এতে। মিসিসিপি নদীর তীরের মানুষ আর স্থানগুলোর বর্ণিল বর্ণনার কারণেই পাঠকের মন জয় করেছে বইটি। বর্ণবাদ নিয়ে ব্যাঙ্গও বইটির সেরা তালিকায় স্থান করে নিতে সহায়ক হয়েছে। টাইমের পাঁচে আছে মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন। এই বইয়ের গল্পের একটি চরিত্র যে কিছুতেই অন্যদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলতে পারেন না। এক সময় জিম নামের এক ক্রীতদাসকে নিয়ে হাকলবেরি ফিন মুক্ত জীবনের সন্ধানে এগিয়ে যায়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের হ্যামলেট
নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র ‘হ্যামলেট’ টাইমের তালিকায় আছে ষষ্ট স্থানে। ঠিক কবে লিখেছিলেন, তার সঠিক কোনো তারিখ পাওয়া যায় না। তবে মনে করা হয়, ১৫৯৯ সাল থেকে ১৬০২ সালের মধ্যে এটি রচিত। ডেনমার্কের রাজা হ্যামলেটকে হত্যা করে তাঁর ভাই ক্লদিয়াসের সিংহাসনে আরোহন, ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে এবং তাঁর ভাতিজা যুবরাজ হ্যামলেটের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনাগুলোই এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে। । হ্যামলেটের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্লুডিয়াস এই নাটকের খল চরিত্র যে কিনা হ্যামলেটের কানে বিষ ঢেলে তাকে হত্যা করেছে। অথচ প্রচার করেছে হ্যামলেট সাপের দংশনে মারা গেছে। ক্লুডিয়াস সিংহাসন নেয়ার পাশাপাশি হ্যামলেটের স্ত্রীর সঙ্গেও পরিণয়ে আবদ্ধ হয়। রাজা হ্যামলেটের ছেলে যুবরাজ হ্যামলেট এসবের কিছুই মেনে নিতে পারেনি। ঘটনার পরিক্রমায় যুবরাজ হ্যামলেটের হাতেই মারা পড়ে ক্লুডিয়াস। তার আগে ঘটে আরো মৃত্যু ঘটনা। হ্যামলেট শেক্সপিয়রের দীর্ঘতম নাটক এবং ইংরেজি সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শোকবহ রচনা বলে পরিগণিত হয়।
স্কট ফিজেরাল্ডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই
১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস গ্রেট গ্যাটসবাই। এই উপন্যাস লেখেছেন আমেরিকান লেখক স্কট ফিজেরাল্ড। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক ধনী যুবক যার নাম জে গ্যাটসবাই। সুন্দরী ডেইজি বুচানের প্রতি জে গ্যাটসবাইয়ের দুর্বলতা আর তার খামখেয়ালিপনার মধ্য দিয়ে সমাজের অবক্ষয় চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে দেখানো হয়েছে লং আইল্যান্ডের এক কল্পিত নগরীতে চরিত্রগুলোর বাস। ১৯২২ সালের এক গ্রীষ্মে ঘটনা এই উপন্যাসে উল্লেখ করা হয়েছে । দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই আছে টাইমের সপ্তমে।
লেখকের নিজের জীবন কাহিনী ইন সার্চ অব লস্ট টাইম
১৯০৯ সাল থেকে উপন্যাসটি রচনা শুরু করেন মারসেল প্রোস্ট এবং ১৯২২ সালের শরতে অসুস্থ হয়ে পড়া পর্যন্ত তিনি এ নিয়ে কাজ করে গেছেন। ফ্রান্সে ইন সার্চ অব লস্ট টাইম উপন্যাসটি ১৯১৩ সাল থেকে প্রকাশ হতে শুরু করে। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত এই বইটি ছাপতে লেখককে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কোনো প্রকাশক যখন তার বই ছাপতে চাইল না তখন তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে ছাপলেন ইন সার্চ অব লস্ট টাইম। লেখকের জীবনের অতীতের নিজের গল্প বইয়ের পাতায় সংরক্ষণ করেছে । ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’ সাত খন্ডের এই উপন্যাসটি এর দৈর্ঘ্যের জন্যও উল্লেখযোগ্য। এর অধ্যায়গুলোর মধ্যে মেডেলিনের অধ্যায়টি সেরা উদাহরণ হতে পারে, যা প্রথম খন্ডেই সংযুক্ত হয়েছে। সি কে স্কট মনক্রিফ এবং টেরেন্স কিলমারটিন উপন্যাসটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই বইটি সেরা বইয়ের তালিকায় টাইম ম্যাগাজিনে আছে অষ্টম স্থানে।
ছোটগল্পের বই দ্য স্টোরিজ অব অ্যানটন শেকভ
ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের লেখক হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয় তিনি হলেন রাশিয়ার এনটভ শেকভ। তিনি প্রথম গল্প লিখেছিলেন নেহায়েত টাকা রোজগারের আশায়, কোনো শিল্প বাসনা থেকে না। অথচ এনটভ শেকভের দ্য স্টোরিজ অব এনটভ শেকভ আছে সর্বকালের সেরা বইয়ের তালিকার নবমে। এটি একটি ছোটগল্পের বই। এখানে তৎকালীন রাশিয়া সমাজের বিভিন্ন গল্প ফুটে উঠেছে। এই বইয়ে রয়েছে তাঁর লেখা গল্পগুলোর মধ্যে সেরা ৩০টি গল্প।
কল্পিত নগরে কাহিনী মিডলমার্চ
গতাণুগতিক জীবনকে ঘিরে ইংরেজ লেখক জর্জ এলিয়ট রচনা করেছেন ‘মিডলমার্চ’। ১৮২৯ সাল থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত মিডলমার্চের কল্পিত নগর মিডল্যান্ডের ঘটনাবলি এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি গল্পের সমন্বয় ঘটেছে এখানে এবং অনেকগুলো প্রধান চরিত্রকে ঘিরে উপন্যাসটি সামনে বেড়েছে। এতে সমাজে নারীর অবস্থান, আদর্শবাদ, স্বার্থপরতা, ধর্ম, ভন্ডামি, রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কৌতুকেরও অভাব নেই এই উপন্যাসে। টাইমের তালিকার দশম স্থানে আছে উপন্যাস মিডলমার্চ আ স্টাডি অব প্রভিন্সিয়াল লাইফ। ১৮৭১ থেকে ১৮৭২ সালে এটি মোট আট খন্ডে প্রকাশিত হয়। মিডলমার্চ নারীর মর্যাদা, বিয়ের ধরন, আদর্শবাদ, স্বার্থপরতা, ধর্ম, কুটিলতা, রাজনৈতিক সংস্কার এবং শিক্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে।