টনসিলাইটিস চিকিৎসায় হোমিও সমাধান
প্রিন্ট সংস্করণ॥ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন
নভেম্বর ১৯, ২০১৯, ০৮:১২ পিএম
টনসিলাইটিস টনসিলের এক ধরনের ইনফেকশন। আমাদের শরীরে কিছু লিম্ফ নোডস থাকে যেগুলো ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিঃসরণ করে শরীরকে রক্ষা করে। টনসিলও এক ধরনের লিম্ফনোড যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমের অংশ এবং দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত ইনফেকশন থেকে নাক, গলা, কানকে রক্ষা করে।
এর সঙ্গে প্যালেটে, নাকের আশপাশের অংশে আরও লিম্ফ নোড থাকে, আর টনসিলসহ এই পুরো অঞ্চলকে ওয়ালডেয়ার রিং বলা হয়। সাধারণ মৌসুমের পরিবর্তনের কারণে টনসিল অথবা টনসিলাইটিসের সমস্যা দেখা যায়। টনসিল শব্দটির সাথে আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি পরিচিত। আমাদের প্রত্যেকেই জীবনে কখনো না কখনো অল্প-বেশি টনসিলের সমস্যায় পড়েছি।
টনসিল সম্পর্কে আমাদের মনে একটা ধারণা হচ্ছে, টনসিল এমন একটা বস্তু যা আমাদের প্রত্যেকের গলায় থাকে। ঠাণ্ডা পানি খেলে বা ঠাণ্ডা খাবার খেলে কিংবা ঠাণ্ডা বাতাসে এই সমস্যা বৃদ্ধি পায়। অপারেশন করে ফেলে দিতে পারলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি! আসলেই কি তাই? মোটেই না। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, আপনার এতদিনের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল।
টনসিল নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ডা. এম এ মাজেদ।
তিনি তার কলামে লিখছেন, টনসিলাইটিস একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। টনসিল ইনফেকশন সাধারণত তিন থেকে ১২ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে বড়দের ক্ষেত্রে যে একেবারেই হয় না তাও নয়। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, টনসিল ইনফেকশনের জন্য ভাইরাস দায়ী। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের জন্যও টনসিলাইটিস হতে পারে।
ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রোপ্টোকক্কাস দিয়ে হয়। অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া দিয়েও টনসিলাইটিস হতে পারে। টনসিল হচ্ছে এক ধরনের লিম্ফ নোড বা গ্রন্থি যা আমাদের গলার পেছনের দিকের অংশে থাকে। টনসিল আমাদের দেহে শ্বেত রক্তকণিকা উৎপন্ন করে থাকে। এই শ্বেত রক্তকণিকা বাইরে থেকে দেহে প্রবেশকারী রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
কখনো শ্বেতরক্তকণিকা জীবাণুর বিরুদ্ধে ঠিকমতো কাজ করতে না পারলেই দেহে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াঘটিত বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু কখনো কখনো এসব জীবাণুকে ধ্বংস করতে গিয়ে টনসিল গ্রন্থি নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে ইনফেকশন হয় এবং এই গ্রন্থি ফুলে যায়। একেই আমরা মেডিকেলের ভাষায় টনসিলাইটিস বলি এবং সাধারণের ভাষায় টনসিলের সমস্যা বলে চিনি।
সাধারণত শিশুরা বাইরে খেলাধুলা করে এবং স্কুলে অনেকে একসাথে থাকে। ফলে টনসিলাইটিস হওয়ার মতো শত কারণের মুখোমুখি হয়। আর এজন্যই শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। তবে যেকোনো বয়সি মানুষেরই টনসিলাইটিস হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টনসিলাইটিস হয়ে থাকে কমন কোল্ড বা অন্যান্য ভাইরাসের আক্রমণের কারণে। ১৫-২০ ভাগ টনসিলাইটিসের কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে। স্ট্রেপ্টোকক্কাল ব্যাকটেরিয়ার কারণে স্ট্রেপ্টো থ্রোট নামক রোগ হয়। এই রোগের লক্ষণকে অবহেলা করলে পরবর্তীতে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
তরুণ লক্ষণ : প্রথম অবস্থায় জ্বর ও গলাব্যথা দেখা যায়। দুই পাশের টনসিল ফুলে লাল হয়ে যায়। অনেক সময় গলার গ্রন্থি সমূহ বৃদ্ধি পেয়ে গলনালী বন্ধ হয়ে যায়। ঢোক গিলতে সমস্যা হয়। খাদ্যদ্রব্য খেতে খুব কষ্ট হয় । মুখ দিয়ে লালা পড়ে। প্রবল কাঁপুনিসহ জ্বর আসতে পারে। ক্রমে টনসিল পাকে ও ফেটে যায়।
পুরাতন লক্ষণসমূহ : বারবার টনসিল প্রদাহ রোগের আক্রমণের শিকার হলে পীড়া পুরাতন আকার ধারণ করে। এতে টনসিলের গঠনের স্থায়ী বৃদ্ধি ঘটে। পুরাতন পীড়ায় রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। নাক বন্ধ করে রোগীকে শ্বাস গ্রহণ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে টনসিল দেখতে একটা বড় সুপারির মতো মনে হয়।মানসিক বৃত্তির পরিবর্তন, শ্রবণশক্তি হ্রাস, কানে তালা লাগা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রদাহের কারণসমূহ—
- কোল্ডনেস বা ঠাণ্ডা লাগাজনিত ও শীতকালীন আবহাওয়া।
- স্যাঁতস্যাতে স্থানে বসবাস, কাজ এবং অবস্থান করা।
- অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধূমপান।
- বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়া।
টনসিল প্রদাহের উপসর্গসমূহ : গিলতে কষ্ট হওয়া, জিহ্বা ও কর্ণমূলে ব্যথা, জ্বর এবং ঠাণ্ডালাগার অনুভূতি হওয়া, মাথা ব্যথা, গলায় ব্যথা ও ক্ষতবোধ, চোয়াল এবং গলায় স্পর্শকাতরতা, গলার দুই পাশের গ্রন্থি বা লিম্ফনোড বড় হয়ে যাওয়া, গলায় সাদা বা হলুদ দাগ থাকতে পারে, গলা খুশখুশ করে আক্ষেপিক কাশি, শিশুদের মধ্যে ক্ষুধামন্দাভাব দেখা দিতে পারে, নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে সমস্যা, টনসিল ফুলে খুব বড় হলে খাবার খেতে বা পান করতে সমস্যা হতে পারে।
টনসিল প্রদাহের জটিলতা—
- ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী টনসিল প্রদাহ ফুলে থাকা।
- দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসনালীতে প্রতিবন্ধকতা, ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
- খেতে বা গিলতে সমস্যা হওয়া।
- কথাবার্তায় জড়তা বা অস্বাভাবিকতা।
- ক্রনিক কর্ণমূল প্রদাহ।
- হার্টের কপাটিকার রোগ।
- ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোকার্ডাইটিস। এ ছাড়াও স্কারলেট ফিভার, বাতজ্বর এবং বিভিন্ন ধরনের হূদরোগও হতে পারে।
টনসিল ডায়াগনোসিস—
- কফ কালচার করলে সংক্রমণকারী জীবাণু সম্পর্কে জানা যায়।
- CBC-তে সাধারণত শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ বাড়তি প্রকাশ পায়।
- ফিজিক্যাল এক্সজামিন করে।
টনসিল রোগীর জন্য কিছু পরামর্শ—
- লবণ পানি : গলা ব্যথা শুরু হলে যে কাজটি কম বেশি আমরা সবাই করে থাকি তা হলো, সামান্য উষ্ণ লবণ পানি দিয়ে কুলি করা। এটি টনসিলে সংক্রামণ রোধ করে ব্যথা কমাতে খুবই কার্যকরী। শুধু তাই নয়, উষ্ণ লবণ পানি দিয়ে কুলি করলে গলায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের আশঙ্কাও দূর করে দেয়।
- সবুজ চা : এবং মধু এক কাপ গরম পানিতে আধা চামচ সবুজ চা পাতা আর এক চামচ মধু দিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এবার আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে চা পান করুন। সবুজ চায়ে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা সব রকম ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে থাকে। দিনে তিন থেকে চার কাপ এই মধু-চা পান করুন। উপকার পাবেন।
- হলুদ দুধ : এক কাপ গরম দুধে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে নিন। গরুর দুধ টনসিলের ব্যথা দূর করতে বেশ কার্যকরী। দুধে অ্যান্টিব্যায়টিক উপাদান আছে। গরুর দুধে হলুদ মিশিয়ে সামান্য গরম করে খেলেও উপকার পাওয়া যায়। হলুদ অ্যান্টি ইনফ্লামেন্টরি, অ্যান্টিব্যায়টিক এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ একটি উপাদান, যা গলা ব্যথা দূর করে টনসিলের সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে থাকে।
- আদা চা : দেড় কাপ পানিতে এক চামচ আদা কুচি আর আন্দাজ মতো চা দিয়ে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিন। দিনে অন্তত দু-তিনবার এটি পান করুন। আদার অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ইনফ্লামেন্টরি উপাদান সংক্রমণ ছাড়াতে বাধা দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গে গলার ব্যথা কমিয়ে দিতেও এটি খুবই কার্যকরী।
- লেবুর রস : ২০০ মিলিগ্রাম উষ্ণ গরম পানিতে এক চামচ লেবুর রস, এক চামচ মধু, আধা চামচ নুন ভালো করে মিশিয়ে নিন। যত দিন গলা ব্যথা ভালো না হয়, তত দিন পর্যন্ত এই মিশ্রণটি সেবন করুন।
হোমিও সমাধান : রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসককে ডা. হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে টনসিলসহ যেকোনো জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিত্তিক লক্ষণ, সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগতভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। কেন না একসময় আমরা শুনতাম যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই, বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষ্মা ভালো হয়। এসব কিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল।
টনসিল চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলো দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।
বিবিসি নিউজের ২০১৬ তথ্য মতে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করে আরোগ্য লাভ করে, আবার ইদানীং অনেক নামদারি হোমিও চিকিৎসক বের হয়েছে, তারা টনসিল রোগীকে পেটেন্ট টনিক, উচ্চ শক্তি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে থাকে। তাদের ডা. হানেমান শংকর জাতের হোমিওপ্যাথ বলে থাকেন। রোগীদের মনে রাখতে হবে, টনসিল কোনো সাধারণ রোগ না, সম্পূর্ণ লক্ষণ সংগ্রহের মাধ্যমে, স্বতন্ত্র ওষুধ নির্বাচন করে অবশ্যই টনসিল প্রদাহ আরোগ্য করা সম্ভব। নির্ভুল ও সঠিক চিকিৎসার জন্য রোগীর অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
এসটিএমএ