কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিকলীর চন্দ্রনাথ গোস্বামীর আখড়া
শাহজাহান সাজু , কিশোরগঞ্জ
ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২০, ১০:২৮ এএম
কিশোরগঞ্জ জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও আয়তনে দীর্ঘ মঠের উচ্চতায় ঐতিহাসিক বিখ্যাত আখড়াটি নিকলীতে অবস্থিত।
প্রাচীন এ স্থাপত্যটি সনাতন ধর্মের নাথযোগীদের প্রধান তীর্থ ছিল মধ্যযুগে। তৎকালে সাধক চন্দ্রনাথ গোস্বামী নাথ সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
নিকলী উপজেলার গোবিন্দপুরে সোয়াইজনী নদীর তীরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে নির্মিত যোগীসিদ্ধা চন্দ্রনাথ গোসাইর মন্দির, সমাধি ও যোগী সম্প্রদায়ের বিরাট আখড়া রয়েছে। একসময় এ আখড়াটিই ছিল এদেশের যোগী সম্প্রদায়ের বিখ্যাত কেন্দ্র। বিগত শতাব্দীতে উক্ত আখড়া থেকে নাথযোগীদের দুস্প্রাপ্য ধর্মীয় হাড়মালার হস্ত লিখিত পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল। যা বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
শৈব, বোদ্ধ, তান্ত্রিক, সহজিয়া ও যোগী এ কয়টি ধর্মমতের সমন্বয়ে উদ্ভূত ধর্মই নাথধর্ম। এ ধর্মের মূল হলো মানবদেহ। দেহেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের ন্যায় নিয়ত সৃষ্টিকর্ম চলছে অর্থাৎ মানব দেহই বিশ্বব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্ররূপ বা অংশ। অপরিপক্ক দেহকে যোগ বা সাধনার দ্বারা পরিপক্ক করতে পারলে শিবত্ব বা অমরত্ব লাভ করা যায়। এই অমরত্ব লাভের সাধনার নামই ‘যোগ’। যোগসাধনপন্থী উক্ত সম্প্রদায়েরর গুরু ছিলেন মীননাথ।
গুরুদের নামের শেষে ‘নাথ’ থাকায় ‘নাথযোগী’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত। সাধক পদ্ধতির ভিন্নতায় নাথপন্থিরা নাথযোগী, কাপালীযোগী ও অবধূতযোগী শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সিদ্ধাছাড়া অন্যান্যরা গৃহী। সিদ্ধাযোগী ও যোগিনীরা বিশেষ ধরণের পরিচ্ছদ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও কানে কুন্ডল পড়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং গোরক্ষনাথ, গোপীচন্দ্রের সন্যাস, নাথগীতিকা, দোহা ইত্যাদি নাথ ধর্মের মাহাত্মামূলক গান পরিবেশন করে ভিক্ষালব্ধ অন্নে জীবিকা নির্বাহ করতো।
মধ্যযুগে উত্তর ও পূর্ব বাংলার নাথ ধর্মের প্রবল প্রভাব এবং প্রসার কালে কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার গোবিন্দপুর ও মিঠামইনের ঘাগড়া নাথ যোগীদের প্রধান পীঠ স্থানে পরিণত হয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অন্যান্য কারণে ষোড়শ শতাব্দীর দিকে নাথ ধর্ম বিলুপ্তির পথে গেলেও উল্লেখিত দুটি এলাকায় দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ সম্প্রদায়ীদের প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন ছিল।
আলোচিত যোগীসিদ্ধা চন্দ্রনাথ গোঁসাইর সঠিক কাল নির্ণয় করা না গেলেও তার প্রধান শিষ্য সিদ্ধাযোগী আদুরী নাথের কাল ধরে চন্দ্রানাথকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদের লোক বলে ধরে নেয়া যায়। আখড়াটি বিরাট। মন্দিরের সুউচ্চ চূড়া বহুদূর থেকে দেখা যায়।
নিকলীর এ আখড়া বাড়িটির গঠনে সহজেই উপলদ্ধি করা যায়-আখড়ার ঐতিহ্য ও প্রভাব। সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা, দু'টি প্রবেশ পথ, শান বাঁধানো ঘাট। কাঠের কারুকার্যে ফুটে উঠে তাদের ধর্মীয় স্মৃতিগুলো।
এক কথায় ভক্ত, পূজারী ও পুন্যার্থীদের আনাগোনায় আখড়া বাড়িটি জমজমাট ছিল। গান বাজনায় জমে উঠতো প্রাঙ্গণ। এখন তা কেবলই স্মৃতি। কালের পরিক্রমায় চন্দ্রনাথ গোস্বামীর আখড়া বাড়িটি জরাজীর্ন এক স্থাপত্য ও কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
আমারসংবাদ/এমআর