অনিন্দ্য শরীফ
এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম
অনিন্দ্য শরীফ
এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ০৬:৩১ পিএম
“নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?”
(সুখ- কামিনী রায়)
সুখ, সে এক প্রহেলিকা, মায়া মরিচীকা। সুখ প্রতিটি মানুষের জীবনের নিরন্তর আরাধনা। সুখ যেন এক যাদু, এই আছে তো এই নাই। সুখ মানুষের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, অভিজ্ঞতা, স্মৃতির আড়াল হতে থেকে থেকে ডেকে ওঠা এক চঞ্চল চড়ুইপাখি। সুখ উত্থান-পতনের তরঙ্গ দোলায় প্রবহমান নিয়ত পরিবর্তনশীল এক রহস্যানুভূতি। সুখ কী মূর্ত, না বিমূর্ত! সুখ কী কেবলই অনুভূতি না সুখেরও কোনো অনন্য বা বহুবিধ রূপ-প্রকাশ আছে! সুখ লৌকিক-অলৌকিক সর্বত্রই বিচরণক্ষম। সুখ এক গোপন প্রেমিক প্রজাপতি, ফুল হতে ফুলচারী অধরা মৌমাছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- এমনি মায়ার ছলনা।
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম,
প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।”
Oxford University এর Wellbeing Research Centre জাতিসংঘের Sustainable Development Solutions Network এবং Gallup এর অংশীদারিত্বে ফিবছর World Happiness Report প্রকাশ করে থাকে। ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৩ টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুখী দেশ হলো ফিনল্যান্ড। এই নিয়ে টানা ৮ম বারের মতো দেশটি এ খেতাব অর্জন করলো। প্রতি বছরের ২০ মার্চ দিনটি বিশ্ব সুখ দিবস হলেও বাংলাদেশে এর কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পালন দৃষ্টিগোচর হয়নি। হয়তো কারণও নেই। কারণ, এ বছরের প্রতিবেদনে দেখা যায় গতবারের তুলনায় ১১ ধাপ পিছিয়ে তার অবস্থান ১১৮ হতে ১২৯ তমতে ঠেকেছে। ২০২২ সালে সে অবস্থান ছিল তালিকার ৯৪ ক্রমিকে। অর্থাৎ সুখের বিচারে আমাদের ক্রমাবনতি ঘটছে।
সুখের প্রকাশ বা অভিব্যক্তি কী রকম। এটা কি একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক? না, ব্যক্তির বাইরেও সুখানুভূতির প্রভাবক বা নির্ণায়ক রয়েছে? কে কীভাবে সুখী হতে চান এটা ব্যক্তি আবহে তিনি নিজেই ঠিক করবেন। এ বিষয়ে নানান জ্ঞানী ও চিন্তাবিদ নানা কথা বলেছেন, যেমন─ No one can make you happy except yourself; Happiness begins where expectation ends; Expectation is the mother all unhappiness; Overthinking is the biggest cause of unhappiness ইত্যাদি। মমতাজ উদ্দীন আহমদ এর গল্পে সুখী মানুষের কোনো জামা থাকে না, তাই অসুখী মোড়লের ভাগ্যেও শেষতক কোনো সুখ ও নিরাময় জোটে না। আবার কবি কামিনী রায়ের ন্যায় অনেকের মতে পরার্থবাদেই (Altruism) প্রকৃত সুখ-
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদো না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
(সুখ- কামিনী রায়)
কেবল নিজের বেশুমার কামাই-রোজগার, অফুরান ভোগবিলাসই কি মানুষকে সুখী করতে পারে? হয়তো, হয়তো না। ব্যক্তি পরিমন্ডলে শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা (acknowledgment বা gratefulness), সবর বা ধৈর্য্য (patience) ও সন্তুষ্টি (satisfaction) সুখানুভূতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ব্যক্তিজীবনে প্রত্যাশা (Expectation) চাহিদা (Demand) জন্ম দেয়, বেহিসাবি চাহিদা তৈরি করে লোভ (Greed); লোভ ডেকে আনে পাপ (Sins) আর পাপ এর পরিণাম বিপর্যয় (Catastrophe) তথা অসুখ ও অশান্তি। তাই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যে ফারাক বা গ্যাপ, এটি যত বেশি সুখ তত কম, অসুখ-অশান্তি তত বেশি।
সুখ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যকার এ সম্পর্কটি গাণিতিকভাবে দেখতে এমন-
সুখ ∝ ১/প্রত্যাশা কিংবা, সুখ ∝ ১/(প্রাপ্তি-প্রত্যাশা)
মহাত্মা গান্ধী যেমনটি যথার্থভাবে বলেছেন, “There is enough in the world for everyone`s need but not for anyone`s greed"।
World Happiness Report এ একজন ব্যক্তিমানুষ তাঁর সুখকে কীভাবে মূল্যায়ন বা অনুভব করেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, উদারতা, জিডিপি, দুর্নীতি- এসকল বিষয়সমূহকে র্যাঙ্কিং এ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সুখকে কীভাবে দেখেন, অনুভব করেন এবং মূল্যায়ন করেন- এটি একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবেশ ব্যক্তির সেই অনুভূতি ও মূল্যায়নকে কীভাবে প্রভাবিত করে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিজীবনে আপনার সুখী হবার লক্ষ্যে যা যা প্রত্যাশা বা চাহিদা সেগুলো পূরণ করবার মতো সক্ষমতা ও সাধ্য আপনার রয়েছে। কিন্তু সুখ বাস্তবায়ন করতে, উপভোগ করতে আপনার যে উপার্জন, আপনার যে উদ্যোগ-আয়োজন, অপরাপর ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় তরফ হতে সেগুলোর নিরাপত্তা বিধান করা যাচ্ছে না, আপনি শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতা ভুগছেন, আপনার প্রতিবেশি, আপনার পরিবেশ আপনার জন্য প্রতিকূল। কিন্তু আপনি কোথাও আপনার প্রতি সংঘটিত অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার চাইতে পারছেন না কিংবা ভরসা পাচ্ছেন না যে, আপনি আদৌ কোনো প্রতিকার বা ন্যায়বিচার পাবেন। তাহলে আপনার সিন্দুকভর্তি অর্থ, বাড়িভর্তি দেশি-বিদেশি দামি আসবাব, সরঞ্জাম, সাজসজ্জা, গ্যারেজভর্তি গাড়ি থাকলেও আপনি কিন্তু সুখী হতে পারবেন না। কিংবা সব ঠিকঠাক আছে আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে আপনার বনিবনা হচ্ছে না, কিংবা আপনার সন্তান বিপথগামী- আপনার সুখ তখন কোথায়!
সুখের একটি অনন্য আত্মিক বা আধ্যাত্মিক শর্ত হলো মানসিক শান্তি। সুখ আর শান্তির মধ্যে এটাই মূল তফাৎ। সুখ অনুভূতির বিষয় হলেও তা প্রদর্শনযোগ্যও বটে। অর্থাৎ আপনি মানুষকে, সমাজকে বাহ্যিক আচারে, বহিরাঙ্গিকে, বাহ্যত দেখাতে পারেন যে আপনি সুখী মানুষ। সুখের অভিনয় করা যায়, সুখী মানুষের ভান ধরা যায়। কিন্তু এমন প্রায়শই হতে পারে অভ্যন্তরীণভাবে কার্যত আপনি অসুখী, কারণ সব সত্ত্বেও কোথা না কোথাও আপনার শান্তির তানপুরার তান নষ্ট হয়ে আছে। শান্তি ছাড়া সুখ অভিনয়। প্রকৃত সুখের জন্য অন্তঃস্থ বা আত্মিক ও বহিঃস্থ বা লৌকিক উভয় প্রকার শান্তিই আবশ্যক। কেননা শান্তি আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে পারে কিংবা বহিঃস্থ নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
শুধু ফিনল্যান্ড নয়, বরং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এবং তার আশপাশের দেশগুলো বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় সবসময় উপরের দিকেই থাকছে। এর কারণ কী হতে পারে? সেখানকার গবেষক, মনোবিজ্ঞানীরা (যেমন, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির সুখবিষয়ক গবেষক জেনিফার ডি পাওলা, ফিনল্যান্ডের মনোবিদ ও সুখগবেষক ফ্রাঙ্ক মারটেলা প্রমুখ) কিছু ব্যক্তিগত বা সমাজগত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ফিনল্যান্ডের অধিবাসীদের ব্যাপারে বলা হয়, তারা বিশ্বাস এবং চর্চা করে যে, সুখ কোনো প্রদর্শনযোগ্য বা প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। যার যার সুখ তার তার একান্ত নিজস্ব। তাই সাধারণত সেখানকার মিলিওনিয়ারদের গ্যারেজভর্তি গাড়ি থাকতে দেখা যায় না। বরং তারা অন্য আর দশজনের মতো সাধারণ গাড়ি, সাইকেল বা গণপরিবহনও ব্যবহার করে থাকেন। তারা সামাজিকভাবে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বদন্দ্বিতা নয় বরং পারষ্পরিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার মূল্যবোধ লালন ও চর্চা করে থাকে। অন্যের সুখ দেখে ঈর্ষাকাতর হয় না, তারা পরশ্রীকাতর জাতি নয়। তারা মনে করে আজকে যার দুর্দিন, তারও একদিন সুদিন আসবে। তাই হতাশ বা বিচলিত হবার কোনো কারণ নাই। এতো গেল ব্যক্তি পরিমন্ডলের কথা।
তাদের ব্যক্তিজীবনে এতটা সুখবিলাসী, উদারমনা, সহিষ্ণু হবার পিছনে সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পরিমন্ডলের ভূমিকাও অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামো হচ্ছে কল্যাণমূলক কাঠামো। তাদের যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণের ভার আক্ষরিক এবং প্রকৃত কার্যকর অর্থে রাষ্ট্রই গ্রহণ করে। তাদের কল্যাণমূলক এই কাঠামো বৈষ্যম্যহীন। অর্থাৎ একজন সাধারণ নাগরিকের সন্তান যে বিদ্যালয়ে যে শিক্ষা, যে হাসপাতালে যে চিকিৎসা গ্রহণ করবে একজন কোটিপতির সন্তানের বেলাতেও তা-ই। অতএব নাগরিকদের মধ্যে ছোটবেলা হতেই পারষ্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগী মনোভাব, সমজাতীয় ও সমস্বভাবের উদার মন-মানসিকতা গড়ে উঠে। রাষ্ট্র নাগরিকের ভরণপোষণ, কর্মসংস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করছে, কর্মহীন নাগরিকদের দায়িত্বও সে গ্রহণ করছে। পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামোতে তাদের সমাজে দুর্নীতির মাত্রা খুবই খুবই কম। আসলে যেখানে কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকে না, ব্যক্তির সকল চাহিদার ক্ষেত্রেই পূরণের নিশ্চয়তা থাকে, সেখানে দুর্নীতির কোনো প্রয়োজনই থাকে না। তারপর যেটুকু থাকে, সেটুকু হলো লোভ। তবে আবার সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থার কারণে এরকম ঘটনার ত্বরিৎ সঠিক ও ন্যয়বিচার হয়ে থাকে। কোনো অন্যায় বা বৈষম্যের শিকার ভুক্তভোগী ব্যক্তি যথাসময়ে প্রতিকার পেয়ে যান, রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্ত হন। তাহলে এ ধরনের রাজনৈতিক স্থিরতার একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে মানুষের কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন, অস্থির, পেরেশান থাকতে হয় না। এর ফলে যে মানসিক নিশ্চিন্ততা ও শান্তি তারা উপভোগ করে তারই দৃশ্যমান প্রকাশ হলো সুখ। কারও সাথে কারও কোনো বিষয়ে কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। আসলে তাদের এগুলোর প্রয়োজনও নেই।
এই যে তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর পরিচিতি উপস্থাপন করা হলো এটিই বহুল আলোচিত সুশাসনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাজেই একজন ব্যক্তি সুখ অনুভব করবে কি না, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়ামকের সাথে সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্রের উপরও অপরিহার্যভাবে নির্ভর করে। সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো ব্যক্তির উপর তার সেই প্রভাবকে বহুল আলোচিত কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কার্যকর করে।
তাহলে সুখী দেশের তালিকায় আমাদের দেশের ক্রমাবনতির কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। সহজ কথায়, আমরা ব্যক্তি হিসাবে সুখে থাকতে চাইলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার পরিচালকদের চরিত্রের কারণে অনেকাংশেই তা সম্ভব হচ্ছে না। কল্যাণরাষ্ট্র নামক গরুটি রাষ্ট্র নামক কাজীর কিতাবে আছে, নাগরিক জীবনব্যবস্থার গোয়ালে নাই। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল যে পুষ্টি- সুশাসন, সেটিও শ্লোগানেই কেবল বন্দী। তাই আমাদের রাষ্ট্র অপুষ্টিতে ভুগছে, সমাজও রুগ্ন। সমাজে ও নাগরিক জীবনে আপাদমস্তক আদ্যোপান্ত অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় ঠাসা। যেখানে একজন নাগরিককে ঘরেবাইরে সার্বক্ষণিক দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ঘোরতর অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা শংকায় দিনাতিপাত করতে হয় সেখানে তার জীবনে সুখ প্রবেশ করার কোনো ছিদ্রও অবশেষ থাকে না। এধরনের পরিবেশে নাগরিকরা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় “কোনোমতে জীবন ধারণ করিয়া” বেঁচে থাকে মাত্র।
গবেষক-বিশ্লেষকদের মতে ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের অসুখী হবার আরেকটি বিশেষ কারণ হলো নানা বিষয়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অহেতুক ও অতিরিক্ত মাথা ঘামানো। আমরা নিজের কাজে কতটুকু মাথা ঘামাই সেটার হিসাব না রাখলেও অন্যের কাজে মাথা ঘামাতে ঘামাতে নিজেরা জলশূন্য হয়ে পড়ি। এটি বাঙালির ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এক মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি। এমনিতেই আয়তনের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যাবোঝাই দেশে সমস্যার অন্ত নাই। সুশাসন, কর্মসংস্থান, বিচার ও ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা- সর্বসঙ্কটের মাঝে আরেকটা বিশাল আপদ হলো বাঙালির সব বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য, পন্ডিতম্মণ্যতা এবং সবকিছুর সরল রাজনীতিকীকরণ। বাঙালি এমন কোনো বিষয় নাই যাতে তার পান্ডিত্য নাই। এমন কোনো বিষয় নাই যাকে বাঙালি রাজনীতিকীকরণ না করে ছাড়ে না। এ রাজনীতিকরণ অতিরাজনীতিকরণ ও অপরাজনীতিকরণ। বাঙালির ঘরে ঘরে সক্রিয় রাজনীতিক সমর্থক, কর্মী ও নেতাতে টইটম্বুর। বাঙালি পাড়ার মোড়ের টং দোকান হতে ঘরের বসার ঘর হয়ে টেলিভিশনের টকশো- সর্বত্রই রাজনীতি নিয়ে ঝগড়াঝাটি, মাতামাতি, হাতাহাতি, কাটাকাটি। আর সামাজিক মাধ্যমতো এবিষয়কে চূড়ান্তভাবে উসকে দিয়েছে। আমার মনে হয় সারা দুনিয়ায় “রাজনীতি সচেতন” এমন দ্বিতীয় কোনো জাতি নাই! এই যে বাঙালির অতি রাজনীতি-সচেতনতা আর সবকিছুকেই অতি রাজনীতিকরণ – এ বিষয়টি দেশের আপামর মানুষের মনের ভিতর এক সার্বক্ষণিক অস্থিরতা তৈরি করে রেখেছে। বাঙালির এ অহেতুক অত্যুৎসাহী চরিত্রটিও তার অসুখী হবার একটা প্রধান কারণ।
EIU (Economic Intelligence Unit) Democracy Index এর একটি কমপোনেন্ট হলো Political Participation Score । এই স্কোরে নাকি বিবেচনা করা হয়- ১) নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি (Voter turnout), ২) রাজনৈতিক কার্যক্রম (Political activism), ৩) রাজনৈতিক সংগঠনে সদস্যভুক্তি (Membership in political organizations), ৪) রাজনৈতিক আলোচনায় সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ (Engagement in political discussions), ৫) স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ (Participation in local governance), ৬) রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা (Women’s participation in politics), ৭) নাগরিক শিক্ষা ও সচেতনতা (Civic education and awareness)। আমি বিস্ময় ও অবিশ্বাসের সাথে লক্ষ্য করলাম, EIU Democracy Index এর Political Participation Score এ অতি রাজনীতি-সচেতন মানুষের দেশ বাংলাদেশের স্কোর ১০ এর মধ্যে মাত্র ৫, যেখানে নরডিক ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর এ স্কোর ১০ বা এর কাছাকাছি। যে দেশের মানুষ চা-দোকান হতে শুরু করে শোবার ঘর পর্যন্ত রাজনীতি নিয়ে নিত্য উন্মত্ত, সেখানে Political Participation Score এ বিবেচ্য বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিতেই আমার হিসাবে বাঙালির বোনাস স্কোর করা উচিত।
অবশ্য একদিকে বিষয়টি ঠিকই আছে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বিপুল সংখ্যক আংশিক বা পূর্ণ বেকার জনগোষ্ঠীর রাজনীতি ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে। তাই এখানে রাজনীতি অনেকের পেশা, অনেকের নেশা, অনেকের শখ, সময় কাটানোর অবলম্বন আর অন্যদের বিনোদন। দেশের রাজনীতি ও এর ভবিষ্যত গতি-প্রকৃতি, গন্তব্য নিয়ে অহর্নিশি যত্রযত্র এত পরিমাণ অনানুষ্ঠানিক গবেষণা, বিশ্লেষণ, যুক্তিতর্ক চর্চা বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হতে দিকপাশহীন সাহারা কিংবা গভীর আমাজনে দুইজন বাঙালি একত্রিত হলেই কেল্লাফতে। বেকারত্ব, কর্মহীনতা, উপার্জনহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা, আর্থসামাজিক বৈষম্য, প্রাণের নিশ্চয়তা- এসকল সমস্যার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত অতি ‘রাজনীতি-সচেতনতা’ বাঙালির মানসিক অসুস্থতা ও অসুখের অন্যতম প্রধান কারণ।
সারকথা হলো, সুখ সরাসরি মানুষের মানসিক প্রশান্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। মানসিক প্রশান্তি ব্যতীত সুখ সোনার পাথর বাটি। ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে সুখ একজন মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা, প্রত্যাশা ও নিজস্ব অর্জনের উপর নির্ভরশীল। তবে মানুষ প্রকৃত বিচারে কতটুকু সুখী হবে তা অনুভব ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব অর্জন এবং অনুভূতির পাশাপাশি এগুলোর উপর সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রত্যক্ষ ও কার্যকর প্রভাব রয়েছে। আর রাষ্ট্র ও সমাজের এই প্রভাবের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নির্ণয় করে সে ব্যক্তির মানসিক প্রশান্তির ব্যাপ্তি ও গভীরতা অর্থাৎ সুখানুভূতির মূল্যায়ন।
ইএইচ