তিস্তা সমাধানের অপেক্ষায় ২ কোটি মানুষ

ইসরাফিল ফরাজী প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০৬:০২ পিএম
তিস্তা সমাধানের অপেক্ষায় ২ কোটি মানুষ

১১৫ কিলোমিটার ব্যাপী তিস্তা অববাহিকায় ২ কোটি মানুষের জীবনে চলছে মহাদুর্যোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা বাংলার মূখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর যখনই হোক তিস্তা চুক্তি থাকে আলোচনার শীর্ষে। এই ইস্যুতে জনগণের আশা ও প্রত্যাশা থাকে সকল কিছু থেকে ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী ৪ দিনের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরছেন গতকাল বৃহস্পতিবার। ৩ বছর আগে ভারত সফরেও তিস্তা সমাধান না করেই ফিরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এবারও ফিরেছেন অমীমাংসীত তিস্তার সমাধান না নিয়েই। এ নিয়ে হতাশ তিস্তা পারের মানুষ। তবে এই বিষয়ে রাষ্ট্র নয়কের এবং ক্ষতাশীলদের ব্যাখ্যা ‌‍‍`অমীমাংসিত সব সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে‍‍`। তবে এই আশ্বাস কতটা যুক্তিগ্রাহ্য বা বাস্তবোচিত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতিসহ বিভিন্ন মহলে।

মঙ্গলবার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দু’দেশের মধ্যে আভ্যন্তরীণ সমস্যা যত থাকুক তা আলোচনার মধ্যে মিটিয়ে নেওয়া হবে। মোদিজির নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের কাছে ভারতই হল একমাত্র ঘনিষ্ঠ ও মূল্যবান প্রতিবেশী। দু’দেশের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রোল মডেল। দু’দেশের মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে অনেক উন্নতি করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। বকেয়া পড়ে থাকা বহু সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছে দু’দেশ। ‘তিস্তা জলবন্টন চুক্তিও খুব শীঘ্রই সমাধান হবে। কুশিয়ারা নদীর জলবন্টন সমস্যা সমাধানের জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। বাকি ৫৪টি নদীর ক্ষেত্রেও এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী মোদি রয়েছেন আশা করি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’-দাবি মুজিব কন্যার।’

এদিন কাগজে কলমে সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তালিকা থেকে বাদ থেকে গেল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা জলবন্টন৷ এমনকি তিস্তা চুক্তি সম্পাদন নিয়ে বড় রকমের কোনও অগ্রগতিও অধরা৷ এর পরিবর্তে আরও একবার শুধুমাত্র ‘মৌখিক আশ্বাস’-কে সম্বল করেই ভারত থেকে ঢাকায় ফিরতে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে৷ যেহেতু নদী জলবন্টন বিষয়ক ইস্যুটি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত, সেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তিস্তার জলবন্টন চুক্তি সম্পাদন করা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই জানেন সকলে৷

রাজারহাট উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা নদী। শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে তিস্তা নদীর জলজ প্রানী বিলুপ্তির পথে। বেকার হয়ে পরেছে হাজার হাজার জেলে।পাশাপাশি পানির অভাবে কৃষি চাষাবাদে বৃদ্ধি পেয়েছে খরচ।আবার ভারত থেকে ছারা অসময়ের পানিতে তলিয়ে যায় কৃষকের ফসিল জমি। খরা,বন্যা ও নদী ভাঙনে তিস্তা পাড়ে ঘরে ঘরে চলছে আহাজারি।জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ক্রমাগত বেসামাল হয়ে ওঠছে। বাড়ছে খরারা প্রকোপ। গজল ডোবা গেট দিয়ে শুকনো মৌসুমে আটকে রাখা হয়েছে পানি।হুমকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। গতবছর ও চলমান বছরে তিস্তা নদীর ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৮শত ৪৮টি পরিবার ও হুমকির মুখে রয়েছে আরো হাজারো পরিবার।  

তিস্তায় ক্ষতিগ্রস্থ কুরিগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একাধিক কৃষক জানান, বাদাম, রসুন, পিঁয়াজ,মরিচ, আলু, ভুট্টা, গমসহ বিভিন্ন ফসল ফলাতে পানির জন্য সেচ ব্যবহার করতে হয়। তিস্তায় পানি না থাকায় ডিজেল কিনে সেচ চালাতে খরচ বেশি হয়। পাশাপাশি অসময়ের পানিতে ফসল তলিয়ে যায় এতে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে পানির সমাধান হবে। আমরা দীর্ঘদিন ন্যায্য পানির হিস্যা হতে বঞ্চিত রয়েছি। পানির সমাধান না হলে কৃষিতে খরচ বৃদ্ধি পাবে।

এবিষয়ে নদী গবেষক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ড. আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান (তুহিন ওয়াদুদ) বলেন, বাংলাদেশ ভারত মিলে দ্বিদেশীয় যত ইস্যু আছে তার অন্যতম হলো তিস্তা। তিস্তা ইস্যুটা জন গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে তিস্তা থেকে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। আর একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে রংপুর অঞ্চলের জনজীবনে এর প্রত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পরছে। রংপুর অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই তিস্তার উপরে নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌসুমে একদমই পানি পাওয়া যায় না আর বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে শুরুতে এবং শেষে দু সময় তারা পানি ধরে রাখে কোন কারণে যদি বৃষ্টি বেড়ে যায় তখন তারা গজলডোবার গেটগুলো খুলে দেয়। এতে করে অকষ্মাত যে বন্যা নেমে  আসে। এই বন্যায় যেমন ফসল ডুবে যায়, পুকুরের মাছ চলে যায় তখন এটা একটা আরেকটা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। তিস্তায় যখন পানি থাকেনা একদম শুকিয়ে যায় তখন তিস্তা পাড়ের ভূমির যে স্বাভাবিক বৈচিত্র-বৈশিষ্ট সেটা নষ্ট হয়। ফলে হটাত যখন পানি আসে তখন ভাঙন আরো তীব্র হয়। এক কথায় শুষ্ক এবং বর্ষা উভয় মৌসুমে তিস্তা আশির্বাদরুপী থাকলেও এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এই অভিশাপ থেকে আশির্বাদে ফেরাতে হলে তিস্তা চুক্তির কোন বিকল্প নেই। ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন ২০১৪ সালে আইনে পরিনত। এই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ি তারা পানি প্রত্যাহার করতে পারেনা। মানবিকতার নিরিখেও পারেনা, সভ্যতার নিরিখে পারে না, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবেও পারেনা, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়িও পারেনা। কোনও ভাবেই তিস্তার পানি তারা প্রত্যাহার করতে পারেনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফরে সমাধান না হলেও অন্ততপক্ষে আলোচনার রুপরেখাটা থাকা দরকার ছিলো। এটা নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে কখনও বসা হবে। এটা আমরা মনে করি।  

ইএফ