আগামী ৩০ অক্টোবর শেষ হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বর্তমান প্রধান মোহা. শফিকুল ইসলামের মেয়াদকাল। এরই মধ্যে পুলিশের নানা মহলে চলছে জল্পনা-কল্পনা, কে হচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম সম্মানজনক পদ ডিএমপির ৩৬ তম প্রধান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেনশীল পদগুলোর মধ্যে একটি ডিএমপি কমিশনারের পদ। যা অতিরিক্ত আইজিপি সমমর্যাদার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ওপরও নির্ভর করে সম্মানজনক এ পদের নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা, কর্মজীবনের সফলতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ছাড়াও নানা সমীকরণ পার হয়েই বসতে হয় ডিএমপি প্রধানের পদে। গ্রহণযোগ্যতা, কর্মজীবনে সফলতা, বিশ্বাসযোগ্যতার সমীকরণসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের (সম্ভাব্য) আলোকে সম্ভাব্য কমিশনার হিসেবে পুলিশ মহলে বেশকটি নাম নিয়ে চলমান জল্পনা-কল্পনায় এগিয়ে আছেন বর্তমান ঢাকা রেঞ্জের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান। এরপরই রয়েছেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম ও মাহবুবুর রহমানের নামও।
ডিএমপির ৩৬ তম কমিশনার হওয়ার আলোচনায় শীর্ষে থাকা পুলিশের চৌকস ও বহুমুখী দুরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে।
১৭ তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে কর্মজীন শুরু তার। তার সৎসাহস, সততা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার বিষয়টি পুলিশ বাহিনী ছাড়াও সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত।
এছাড়া সার্বিক বিবেচনায় তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকেও (পিপিএম) ভূষিত হয়েছেন তিনি। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), ডিএমপি সদর দপ্তরের উপ কমিশনার, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন), ডিআইজি প্রশাসনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালনে সাফল্যের জানান দিয়েছেন ডিআইজি হাবিব। পেশাগত ও মানবিক কাজের বাইরে সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছেন বহুমুখী গুনে গুনান্বিত পুলিশের এই কর্মকর্তা। পাশাপাশি মানবসেবার লক্ষ্যেও গড়েছেন সেবামুখী প্রতিষ্ঠান- উত্তরণ ফাউন্ডেশন। কর্মক্ষেত্রে সততা, সাহসিকতা, দক্ষতা আর সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে অর্জন ইতোমধ্যেই করেছেন বহুমুখী সাফল্য। বিভিন্ন মহলে যা নিয়ে রয়েছে তার সুখ্যাতি।
ডিআইজি হাবিবুর রহমানের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হওয়া সবশেষ পালক- পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যেটি তার একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়। সবার জন্য ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নবনির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন। ২০১৮ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের গৌরবান্বিত ভূমিকা তুলে ধরে ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামের একটি বই সম্পাদনা করেন ডিআইজি হাবিব। সবশেষ (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২) রোববার বইটির দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশ হয়। এছাড়া এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার গবেষণাগ্রন্থ ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’। বইটিতে তিনি বেদেপল্লির অজানা ভাষাকে সবার মাঝে পৌঁছে দিতে লিখিত বইয়ের সহায়তা নিয়েছেন।
তাছাড়া তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়েও বই সম্পাদনা করেছেন। বইটিতে তুলে ধরেন মন্ত্রীর বাল্যকাল, পড়াশোনা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ রাজনীতিতে অংশ নেয়ার বিষয়গুলো। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ নামক বইটি। বেদে সম্প্রদায়ের জন্যও কাজ করে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন হাবিবুর রহমান।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের হাট বাসুদেবপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করে সান্দার বেদে গোত্রের প্রায় দু’শ পরিবার। যাদের শতভাগই মুসলমান। অথচ এ জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে মুসলমান হিসেবে জানাজা ও দাফন-কাফনও হতো না। পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে আশপাশের কোনো কবরস্থানে তাদের কবরও দেয়া হতো না। এমন করুণ অবস্থা জানতে পেরে অবহেলিত এই জনগোষ্টীর কল্যাণে সহকর্মীদের সহযোগিতায় একটি জায়গা খুঁজে কিনে দান করেন ডিআইজি হাবিব।
এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও কর্মসংস্থান নিশ্চিতে করেছেন পশু খামার। অনেককে পোশাক কারখানায় চাকরি, পারলার ও খাবার দোকানের ব্যবসা গড়ে দিয়ে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ডিআইজি হাবিব। মানবিক ডিআইজি হাবিবুর রহমান এখন নতুনভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লির শিশুদের জন্যও কাজ শুরু করেছেন। যার সুফলও মিলছে। বিশেষ করে যৌনপল্লির শত শত শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তার নিজ উদ্যোগে হাতে গড়া উত্তরণ ফাউন্ডেশন।
ডিআইজি হাবিবের পরই পুলিশের শীর্ষ এই পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি ১৫ তম বিসিএসে যোগদান করেন। মনিরুল ইসলামও ১৯৭০ সালের ১৫ জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রিটিশ আইনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি গোয়েন্দা শাখায় নয় বছর এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পুলিশের নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে তার অর্জন উল্লেখযোগ্য। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। কর্মজীবনে স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ পদক ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পেয়েছেন।
এছাড়াও আলোচনায় রয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (ডেভেলপমেন্ট) হিসেবে কর্মরত মো. আতিকুল ইসলাম এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ প্রধান (অতিরিক্ত আইজিপি) মাহবুবুর রহমান। আতিকের জন্ম ১৯৬৬ সালে রংপুর জেলার কোতোয়ালি থানার জুম্মাপাড়ায়। তিনি আইপিজিএমআর, (ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ) বর্তমানে বিএসএমএমইউ থেকে ফার্মাকোলজি বিষয়ে স্নাতক এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। বিসিএস-১২ তম ব্যাচের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন তিনি। আর মাহবুবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ১৫ তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগ দেন। এএসপি হিসেবে নরসিংদী জেলা পুলিশে, সার্কেল এএসপি হিসেবে কিশোরগঞ্জ জেলার সদর সার্কেল ও বাজিতপুর সার্কেলে এবং এএসপি সদর সার্কেল হিসেবে নেত্রকোনা জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি) হিসেবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ র্যাবেও কর্মরত ছিলেন তিনি।
কেএস