আগামী ১০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার’ মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। যা বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এর সম্ভাব্য সব ধরনের প্রভাব মোকাবিলায় বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
রোববার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে কসমস ডায়ালগের সর্বশেষ সংস্করণে মূল বক্তব্য দেয়ার সময় প্রখ্যাত লেখক, কূটনীতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ কিশোর মাহবুবনী এসব কথা বলেন।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সাবেক ডিন মাহবুবনী বলেছেন, ‘আপনারা যেখানেই থাকেন না কেন, আপনারা যাই করেন না কেন, আপনাদের জীবন এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বারা প্রভাবিত বা ব্যাহত হবে। আমি আপনাদের গ্যারান্টি দিতে পারি।’
কসমস গ্রুপের জনহিতকর বিভাগ ‘কসমস ফাউন্ডেশন’ তার চলমান রাষ্ট্রদূতের বক্তৃতা সিরিজের অংশ হিসেবে এই সংলাপের আয়োজন করছে।
কসমস ফাউন্ডেশন, কসমস গ্রুপের জনহিতকর শাখা ‘কসমস ফাউন্ডেশন’ এর বিশিষ্ট বক্তাদের বক্তৃতা সিরিজের অংশ হিসেবে ‘ইমার্জিং এশিয়ান নেশনস ইন গ্লোবাল জিওপলিটিক্স: ইমপ্লিকেশনস ফর বাংলাদেশ’- শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করেছে। যার সভাপতিত্ব করেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
বেইজিং ও ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সখ্যতা থাকা বিশ্লেষক মাহবুবনী বলেছেন, বিশ্ব একটি কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে রয়েছে।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে ‘ইতিহাসের শুরু থেকে সবচেয়ে বড়` প্রতিযোগিতা বলে অভিহিত করেছেন।
মাহবুবনী ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি স্পেলসহ জাতিসংঘে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দুই দফা দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক রাখতে চায় বলে অসুবিধা হবে এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
তিনি বলেন, আসিয়ানের মতো কার্যকর কোনো আঞ্চলিক সংস্থার অনুপস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা কঠিন।
মাহবুবনী বিশ্বাস করেন যে সার্ক অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায়, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতার ফল বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলবে।
এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি একাধিক মোড় নেবে। যা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জটিল ম্যাট্রিক্সে পরিণতি পাবে এবং একবিংশ শতাব্দী উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি সম্ভবত একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করবে।
তিনি বলেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এই প্রতিবন্ধকতাগুলো আরও জটিল। এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ এখনও উন্নয়নশীল থাকায় এই জটিলতাগুলো তাদের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য।
খান বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে এমন মনোভাব তৈরি করতে হবে যা তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং তার অর্জনের ফল রক্ষা করতে সক্ষম করবে।
তিনি বলেন, ‘এছাড়া আমাদের জলবায়ু-পরিবর্তনের অসহনীয় প্রভাব এবং মহামারির মতো ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদগুলো মোকাবিলা করতে হবে।’
ড. চৌধুরী বলেছেন যে বিশ্ব একটি সিরিজ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং এই তালিকাটি দীর্ঘ। ‘এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- অভ্যন্তরীণ ও এক জাতির সঙ্গে আরেক জাতির দ্বন্দ্ব, মহামারি ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, জলবায়ুর কারণে সৃষ্ট জরুরি অবস্থা, ঋণের সঙ্কট, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন এবং ক্রমান্বয়ে বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়া।’
এই পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক নিয়ম ও মানদণ্ডের ওপর মারাত্মকভাবে চাপ রয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সামাজিক কম্প্যাক্টগুলো ভেঙে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ‘অস্ট্রেলীয় পণ্ডিত কোরাল বেল এই পরিস্থিতিটিকে একটি অসহনীয় সংকট স্লাইড হিসেবে বর্ণনা করতেন।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানতে চান, চীন ও ভারতকে কাছাকাছি আনতে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ আছে কি না।
এর প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ‘আমি অবশ্যই বলব এটি একটি খুব চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন। সত্যি বলতে এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে।’
তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের একটি বড় প্রতিবেশি এবং বাংলাদেশের অবশ্যই বড় প্রতিবেশির সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ রাখতে হবে।
মাহবুবনী আরও বলেন, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ‘চায়’ এবং মাঝখানে (ভারত-চীনের) ভূমিকা রাখার চেষ্টা করলে (বাংলাদেশের) সম্ভাব্য বিপদ রয়েছে।
তিনি বলেন, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অসাধারণ সুযোগও হতে পারে। ‘আমি সুযোগ বলছি, কারণ বাংলাদেশের এমন একজন নেতা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) থাকার সুবিধা আছে, যিনি টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছেন। আপনাদের একটি খুব সুপ্রতিষ্ঠিত একজন নেতা আছেন, যিনি তাদের অবস্থানের মধ্যে একটি সুরক্ষিত পার্থক্য তৈরি করেছেন।’
ভালো নেতৃত্বের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করে তিনি বলেন, সম্প্রতি বালিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হতোনা, যদি-না ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে চাপ না দিতেন। যার ফলে শেষ পর্যন্ত দুই দেশ জি২০ এর সাইডলাইনে বৈঠকে বসে।
জোকো উইদোদোকে মানুষের কাছে সম্মানিত একজন প্রতিষ্ঠিত নেতা হিসেবে বর্ণনা করে মাহবুবনী বলেন, ‘নিঃশব্দে, কিন্তু তিনি তা করেছিলেন।’
মাহবুবনী আরও বলেন, ‘সুতরাং, একইরকম সুযোগ আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে নিঃশব্দে এটি করতে হবে এবং ভারতকে (নেপথ্যে) বলতে হবে যে চীনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করুন এবং চীনকেও (নেপথ্যে) একই কথা বলতে হবে।’
৩৩ বছর (১৯৭১ থেকে ২০০৪) সিঙ্গাপুর ফরেন সার্ভিসে দায়িত্ব পালন করা এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিশ্ব আর এই মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতায় সন্তুষ্ট নয়।
তিনি বলেন, ‘তারা (বিশ্ববাসী) চায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এর (দ্বন্দ্বের) অবসান করুক এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করুক।’
তিনি আরও বলেন, আকার ও শক্তিতে সমকক্ষ হিসেবে খুব কম দেশেরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে কথা বলার সক্ষমতা আছে এবং এই (সক্ষমতা থাকা) কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি হল ভারত।
মাহবুবনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতা জানানো অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর ছিলেন।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) বিশিষ্ট ফেলো ও বোর্ড সদস্য রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি (বিআইপিএসএস) মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড.জাইদি সাত্তার, বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান, বাংলাদেশে সিঙ্গাপুরের কনসাল শীলা পিল্লাই, বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু হারতান্তো সুবোলো, বিআইপিএসএস-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেররিজম রিসার্চের (বিসিটিআর) প্রধান শাফকাত মুনির এবং প্রথম আলোর ইংলিশ ওয়েবের প্রধান আয়েশা কবির প্রমুখ সংলাপে যোগ দেন।
ইএফ