পত্নীতলায় হার না মানা ৩ জয়িতার গল্প

পত্নীতলা (নওগাঁ) প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২২, ০৭:৩৬ পিএম
পত্নীতলায় হার না মানা ৩ জয়িতার গল্প

অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার হার না মানা তিন জয়িতা নারী। তারা প্রমাণ করেছে, কী করে লড়াই করে সফল হওয়া যায়। পত্নীতলা উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’-এর নির্বাচিত এই তিনজন সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। 

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী কল্পনা রাণী: 
পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর ইউনিয়নের দোচাই গ্রামের সুধাংশুর সাথে কম বয়সে বিয়ে হয় কল্পনা রাণীর। বিয়ের পর থেকে শুরু হয় কল্পনার অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। এর মধ্যে কল্পনার পাঁচ সন্তান জন্ম নেয়, সংসার বড় হতে থাকে। স্বামী সুধাংশুর ছোট ১টি পানের দোকান থেকে সংসার চলা দুঃসাধ্য ছিল। এমতাবস্থায় ২০০১ সালে ব্র্যাক অফিসের সাথে যোগাযোগ করে ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে সেবিকার কাজ শুরু করে। তার পর ২০০৬ সালে তিনি ব্র্যাক সামাজিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্ম সূচিতে নাট্য শিল্পি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০৭ সালে ব্র্যাক মাইক্রো ফাইনান্স কর্মসূচি হতে ১০,০০০/- টাকা ঋণ নিয়ে ছেলের দ্বারা পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন। সে ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেন। পাশাপাশি অবসর সময়ে কল্পনা নকশি কাথা শেলাই ও গাভী মোটা তাজা করনে সাফল্য অর্জন করেন। তিনি ১ ছেলেকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মেয়েদের সুশিক্ষিত করে পাত্রস্থ করেছেন। এখন তার পেছনে ফেরার অবস্থা নেই। শুধু সামনে এগিয়ে যাবার সময়। আজ কল্পনা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী। সকলের পরিচিত মুখ।

নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে নতুন জীবন ক্যাটাগরিতে জয়িতা হয়েছেন মোসলেমা খাতুন:
পত্নীতলা উপজেলার পাটিচরা ইউনিয়নের রসকানাই গ্রামের মোস্তাফিজুরের সাথে সামাজিক প্রতিকুলতার কারণে মোসলেমার বাল্য বিয়ে হয়। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে ৭/৮ বছর ভালোই ছিলেন মোসলেমা। এরি মধ্যে তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করে। অভাবের কারণে পরিবারে সহযোগীতা করার জন্য কখনো অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ,আবার অন্যের নকশি কাঁথা শেলাই করে সংসার চালাছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার বড় হওয়ার স্বপ্ন হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। স্ত্রী সন্তানদের কে রেখে তার স্বামী জড়িয়ে পরে পরকীয়া সম্পর্কে। শুরু হয় মোসলেমার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ২০০৮ সালে তার স্বামী ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি করে। মোসলেমা যৌতুক আনতে রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তার স্বামী। মোসলেমার জীবনে শুরু হয় আরেক অধ্যায়। একে তো বাবার অভাবের সংসার তারপর আবার পাড়াপশী ও সমাজের তিরস্কার । তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের করেন। মোসলেমার স্বামী তার ভুল বুঝতে পারে এবং নিজেরদের মধ্যে আপোস মিমাংসা করে মোসলেমাকে সংসারে ফিরিয়ে আনেন। নির্যাতনের বিভিষিকা ও সমাজের তিরস্কার ভুলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করে মোসলেমা।

সমাজ উন্নয়নে অবদান মুন্নি আরার: 
ধামইরহাট উপজেলার ফার্শিপাড়া গ্রামের দিনমজুর মশিউর রহমানের মেয়ে মুন্নি আরা। হতদরিদ্র পরিবারের তৃতীয়তম কন্যা সন্তান মুন্নি আরা। দিনমজুর পিতার পরিবার ও তিনটি মেয়ে সন্তানের ভরনপোষন চালানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। একটি অবহেলিত ও নির্যাতিত পরিবারের মধ্যে মুন্নির বাল্য জীবন শুরু হয়। এক পর্যায়ে পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ফার্শিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ধামইরহাট সফিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ায় পরিবার ও প্রতিবেশীরা খুশি হয়। এস.এস.সি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ায় ডাচ্ বাংলা ব্যাংক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনার জন্য উপবৃত্তি দেয় সেই দিয়ে এইচএসসি পাশ করে অর্নাসে ভর্তি হয়। পড়াশুনার পাশাপাশি সামাজিক অনেক কাজও করে মুন্নি আরা। সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ওর্য়াল্ড ভিশন সাথে যুক্ত হয়ে গ্রামের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাদান, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন বিষয়ে কাজ, গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, গ্রামের অনেক মেয়েকে বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করা, এছাড়া গ্রামের ২০ জন সদস্যকে নিয়ে একটি সঞ্চয়ী সামাজিক উন্নয়নমূলক দল গঠন করে গ্রামের ও পরিবারের মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও উন্নয়ন সাধন করে আসছে মুন্নি আরা। অর্নাসে পড়াকালীন দ্বিতীয় বর্ষে পত্নীতলা উপজেলার বিষ্টপুর গ্রামের আল-আমিন হোসেনের সাথে বিয়ে হয়। এখনো সমাজ এবং নারীদের উন্নয়নে নীরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন মুন্নি আরা। 

কেএস