বরিশালে পলিথিনের ভয়াবহ আগ্রাসন

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২২, ০৪:২০ পিএম
বরিশালে পলিথিনের ভয়াবহ আগ্রাসন
  • পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসন নীরব
  • বর্জ্য ও ময়লায় বেহাল নগরীর ২২ খাল
  • দুই দপ্তরের ঠেলাঠেলিতে বন্ধ খাল খনন

বরিশাল নগরীর জেল খাল সহ ২২টি খাল পলিথিন আর প্লাস্টিক বর্জ্যে দিয়ে ঠাসা পুরো। কোথাও কোথাও পলিথিনের বড় স্তূপ থাকার কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খাল গুলো যেমন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য একাকার হয়ে আছে, অন্যদিকে  দখলে-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগরীর পয়নিষ্কাশনের খাল, নালা-নর্দমা। এমনই ভয়াবহ চিত্র নগরীর লাকুটিয়া খাল, জেল খাল ও পোর্ট রোড অংশের খালসহ ২২টি খালের। সচেতন নাগরিক ও পরিবেশবিদদের মতে, পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধে কঠোরতার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে পরিবেশ অধিদফতর বলছে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে শীঘ্রই কঠোর অভিযোন পরিচালনা করা হবে।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অভিজাত রেস্টুরেন্ট, মুদি দোকান, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ফুটপাতের প্রায় সব দোকানের পণ্য বহনে ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ। সহজলভ্য ও ব্যবহারে সুবিধা থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই ক্ষতির দিক বিবেচনা না করে পলিথিন ব্যাগ দেদারছে ব্যবহার করছেন। পলিথিন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও এক শ্রেণির অসচেতন অসাধু ব্যবসায়ী নানা কৌশলে প্লাস্টিক বস্তা ও পলিব্যাগে (পলিথিন) বিক্রি করছে চাল, ডাল, মাছসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। যে কারণে পলিথিন ব্যাগে সয়লাব বরিশাল জেলার সব এলাকা। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সংগৃহীত বর্জ্যের বড় অংশই পলিথিন ব্যাগ। নগরবাসীর ব্যবহৃত এসব পলিথিনের বড় একটা অংশ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয় সিটি করর্পোরেশন। ফলে এসব ব্যাগ যত্রতত্র পড়ে থেকে দূষণ ঘটাচ্ছে মাটিতে। এছাড়া নগরবাসীর ব্যবহৃত পলিথিনের চূড়ান্ত গন্তব্য খাল ও নদী হওয়ায় মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে পানিতে। নগরীর অধিকাংশ ড্রেনে পলিথিনের স্তূপ জমে থাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

বরিশালের সচেতন নাগরিকরা বলেন, পলিথিনের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে বরিশাল বিভাগ জুড়ে। বাজার থেকে যা কিনবেন সবই পলিথিন ব্যাগে দেওয়া হচ্ছে। আর সেই পলিথিন ব্যবহার শেষে খাল অথবা ড্রেনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যত্রতত্র ড্রেন, নালা, খাল ও নদীতে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য দেখা যায়। পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে এখনই কার্যকর পদক্ষে নেওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করেন তারা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের যথার্থতা নিরূপন ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কঠোর হতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলকের পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ নিষিদ্ধ করতে নগরীতে তাদের কোন ভূমিকা নেই বলেই চলে। আইনের কঠোর প্রয়োগ ও নিয়মিত অভিযান না থাকায় পলিথিনের বিক্রি ও ব্যবহার আগের তুলনায় ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে।

এ অবস্থায় পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম বলেন, প্রথমত পলিথিন যেখানে উৎপাদন করা হয় সেখানে আগে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত: পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা এবং পলিথিন বহনকারীদের কঠোর নজরদারীর আওতায় আনতে হবে। এছাড়া পলিথিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, প্রায়ই পলিথিনিরে ওপর আমাদের অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, খুব শীঘ্রই আমরা পলিথিন বন্ধ করার জন্য কঠোর অভিযোন পরিচালনা করবো।

সূত্রমতে, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘জনগণের জেল খাল, আমাদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ এই শ্লোগানে হাজার হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে নগরীর ২২টি খালে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক গাজী মো. সাইফুজ্জামানের উদ্যোগে পরিচ্ছন্ন অভিযানের আগে খালের দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। ওই সময় ২৫৫ দখলদারের তালিকাও করা হয়েছিল। উচ্ছেদ এবং পরিচ্ছন্নতা অভিযানের পর কীর্তনখোলার ভরা জোয়ারে জেল খালের বুকে পানি থৈ থৈ করত। কিন্তু দুই এক বছর না যেতেই ফের দখলদারদের আগ্রাসন এবং ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে খালগুলো এখন মৃতপ্রায়। তৎকালীন জেলা প্রশাসন ওই খালগুলোর তীরে খালের নামসহ সাইনবোর্ডও স্থাপন করেছিল। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে সেই খালগুলো পলিথিন আর প্লাস্টিক বর্জ্যে দিয়ে ঠাসা হয়ে আছে। সাইনবোর্ডগুলোর অস্তিত্বও বিলীন। অথচ এসব খাল দিয়ে এক সময় যাত্রীবাহী ও পণ্যবোঝাই নৌকা চলাচল করত। গয়নার নৌকা চলত জেলার বিভিন্ন নৌপথে। নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ ছিল খালগুলো। দখলদারদের দৌরাত্ম্য আর ময়লা-আবর্জনায় খালগুলো এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণে ভারি বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও খাল গুলো যেমন পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে একাকার হয়ে আছে, অন্যদিকে দখলে-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। সচেতন মহলের মতে, অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগরীর পয়নিষ্কাশনের খাল, নালা-নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানা যায়, দখল-দূষণে মৃতপ্রায় নগরীর ২২ টি খাল খননে জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রাণলয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডও খাল খননে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো। তবে দুই দপ্তরের ঠেলাঠেলিতে খাল খনন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এতে করে ভোগান্তিতে রয়েছে নগরবাসী উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম জানান, সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবনায় ২২টি খালের মধ্যে শুধুমাত্র সাগরদী খালের নাম উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবনা কবে নাগাদ অনুমোদন হবে তা নিশ্চিত নয়। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল খনন কার্যক্রমের অনুমোদনের পাশাপাশি বরাদ্দও এসে গেছে।

এমতাবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড খাল খনন কাজ করতে না বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত যাওয়ার শংকার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট দফতর ও জনপ্রতিনিধিরা এব্যাপারে একমত না হলে নগরবাসীর ভোগান্তি ভবিষ্যতে আরো তীব্র হবে। তবে নগরীর ৭টি খালের ১৯ কিলোমিটার খনন কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। আর খাল সংস্কারের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়ন হবে এমনটাই প্রত্যাশা বরিশাল নগরবাসীর।

কেএস