গাজীপুরের নদী নালা এবং খাল বিলের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২২, ০১:০০ পিএম
গাজীপুরের নদী নালা এবং খাল বিলের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে

গাজীপুরের উল্লেখযোগ্য নদী নালা এবং খাল বিলের পানি মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। এখন সেই পানিগুলো ফসলে ব্যবহারেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন কল কারখানার নির্গত দুষিত বর্জ্যে পানি ব্যবহারে অযোগ্যতা ক্রমশ: বিস্তৃত হচ্ছে। বিষাক্ত রাসায়নিক পানি একত্রিত হয়ে পড়ছে তুরাগে।

সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের শ্রীপুর পৌররসভার গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী এলাকায় লবলং খালে কারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলে পানি প্রবাহ বন্ধ এবং পরিবেশ দুষণ সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে আশংকার কথা জানিয়ে বলেন, শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মুল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। একসময় সারা বাংলাদেশই দিবে। বাংলাদেশের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এইখান থেকে আসে।

পাশের বানিয়ারচালা গ্রামের যুবক সোহাগ মিয়া বলেন, ১২ বছর আগেও লবনদহ খালের সরু সেতুর ওপর এলাকার মানুষ অবকাশ যাপন করতে যেত। খালে প্রবহমান ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে মুখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ খাল দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা ও গাজীপুরের শ্রীপুর এবং সদর উপজেলার অধিকাংশ কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য প্রবাহিত হয়।

গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার স্থানীয় যুবক সবুজ মিয়া বলেন, লবনদহ খালটি শ্রীপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে সদর উপজেলার বানিয়ারচালা, ভবানীপুর হয়ে মির্জাপুরে গিয়ে শালদহ নদীর সাথে মিশেছে। শালদহ নদীতে প্রবাহিত হয়ে বিষাক্ত বর্জ্য তুরাগে গিয়ে পড়ছে।

ভবানীপুর এলাকার গৃহিণী আমেনা খাতুন বলেন, নাকে মুখে রুমাল দিয়ে রাখতে হয়। বর্ষাকালে কালো পানি কিছুটা রং বদলায়। ঈদের সময় কারখানা বন্ধ থাকলে পানি সাদা হয়। কারখানা খোলা হলের আবার পানির রং কালো হয়।

স্কুল ছাত্র শিমুল, জনি ও রাজীব বলেন, বাইরে খেলাধুলা করতে বের হলেই ঝাঁঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম দুর্গন্ধ অব্যাহত থাকলে মানুষ বাঁচবে না।

স্থানীয় কৃষক আফাজ উদ্দিন নূরু বলেন, এখন সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। তারপরও পানির ঝাঁঝালো গন্ধ রয়ে গেছে। কারখানার বিষাক্ত পানির সাথে প্রাকৃতিক পানি মিশে যেতেও সময় লাগে। কারখানার রাসায়নিক পানির বৈশিষ্ট্য এমন যে, বৃষ্টির পানিতে বেড়ে যাওয়া খালের পানি জমির পানির সাথে মিশে যেতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় লাগে। শুষ্ক মৌসুমে রাসায়নিক পানির দুর্গন্ধের তীব্রতা এলাকার বাতাসকেও দুষিত করে তোলে। আগে তিনি নিজেই চাষাবাদ করতেন। বছর দশেক যাবত তার জমি বর্গা দিয়েছেন। পানি বিষাক্ততার কাণে তিনি নিজে এখন আর চাষাবাদ করেন না। খালে নেমে যাওয়ার ভয়ে গবাদি পশুগুলো উম্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে পালন করতে পারেন না।

শ্রীপুর উপজেলা জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, লবলং খালের পানি ছিল স্বচ্ছ, খুব সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেতো, বর্তমানে দখল ও দূষণের কারণে মাছ তো দূরের কথা কোন জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। একদিকে দূষণ অন্যদিকে দখল, এ দুই মিলে আজ লবলং খাল বিলুপ্তির পথে। দখল ও দূষণ মুক্ত করার জন্য নদী রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রশাসনকে বলে আসছি। কিন্তু, দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশননের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিবেশের মুল দূষণকারী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের যে নিদারুন অবহেলা সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গাজীপুরের যে পানি সেটা বিষাক্ত হয়ে গেছে। এই জনপদ একটা বিষাক্ত জনপদে পরিণত হয়ে গেছে। শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মুল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। একসময় সারা বাংলাদেশই দিবে। বাংলাদেশের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এইখান থেকে আসে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে কখনোই বলবনা ইন্ডাস্ট্রী বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমরা শুধূ এটাই বলবো যে ম্যানেজমেন্ট চেঞ্জ করে দেন। অথবা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তার করতে বলব। দোষ হচ্ছে যারা এটা পরিচালনা করে ম্যানেজাররা। তাদের প্রতি আহবান জানাতে চাই আগামী প্রজন্মের কথা মনে রেখে আপনারা দুষণমুক্ত শিল্প গড়ে তোলুন।

বিশাল কারখানার সমান্য জরিমানা দিয়ে ক্ষতিপূরণ হবে না। আইন খতিয়ে দেখে যারা পরিবেশের ক্ষতি করছে তাদের জেলে নিতে হবে। লবনদহ সাগরকে নদী বানানো হয়েছে, সাগরকে বলবেন নদী, এরপর বলবেন খাল, খালকে বলবেন ড্রেন, ড্রেনকে বলবেন কাভার্ড ড্রেন।

তিনি বলেন, টিটু নামে একজন খালে ময়লার ফেলার মাধ্যমে ব্যবসা করছে। আরও একজন আছে। প্রশাসনকে বলব তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনকে দুই মাস সময় দিলাম পরিবেশ দুষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাব্যস্থা নেওয়ার জন্য।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, অনেক কারখানা বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করে। আমরা অতি সমপ্রতি মেঘনা নীট কম্পোজিট কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যানটা (পিএইচ) বন্ধ পেয়েছি। তারা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) বলেছে পানির লেবেলটা বাড়লে তারা প্ল্যানটা চালু করে। এটা অনেক বেশি টেকনিক্যাল বিষয়। এখন আলোচনা করা যাবে না।

কেএস