যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। এই প্রবাদটি নারীদের সাফল্যের ক্ষেত্রে এক কথায় বলা হয়। রাঁধে এবং চুল বাঁধে প্রবাদটি তাদের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। সত্যিকার অর্থে যারা ঘর সংসার সামাল দিয়ে বাইরে জগতে নেতৃত্ব দেন বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অথবা মানবতার কাজে ইত্যাদিতে যে নারী নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। এরমধ্যে চিরন্তন সত্য, গ্রাম ও শহরের নারীদের মধ্যে আকাশ জমিন পার্থক্য। শহরের নারীদের জীবন যাপনের সাথে গ্রামীণ নারীদের পার্থক্য করাই কঠিন।
শহরে কন্যা শিশু জন্ম নেওয়ার পর তার মা-বাবার খুব আদর যত্নে বড় করেন। ঘর সংসারের কাজ বা রান্নার কাজের সাথে পরিচয় পর্যন্ত হয়ে উঠে না। তারা শুধু প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেকে এক নাম্বার বিজয়ী করার জন্য সকল কৌশল রপ্ত করে থাকেন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পা রাখেন। তাদের সাফল্যের পেছনে নিজের মা বাবা ভাই এমনকি স্বামীর একান্ত প্রচেষ্টা থাকে। বর্তমান সময়ে শহরের অনেক নারীরা সখের বসত রান্নার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কিভাবে সুস্বাদু ও ব্যতিক্রমী রান্না করা যায়।
বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া তাঁর ‘জাগো গো ভগিনী’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘স্বামীরা যখন পৃথিবী থেকে মঙ্গল বা গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্ব মাপায় ব্যস্ত, স্ত্রী তখন বালিশের কভার মাপেন। খুব অল্প সময়ে বাঙালি নারীরা তাঁর এই আক্ষেপে বিস্ময়কর পরিবর্তন আনতে পেরেছেন, এ কথা সত্য। এ চরম বাস্তবতার সত্যে শহরের নারীরা এগিয়ে। গ্রামীণ নারীদের জীবনধারা শহর নারীদের মত ইচ্ছে করলেই পরিবার সমাজের কারণে করতে পারে না। কন্যা শিশু জন্ম হয়ে বেড়ে ওঠার পর নামকো ওয়াস্তে পড়ালেখা করে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। এরপর বাচ্চা জন্ম দেওয়া ও লালন পালন করা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় তাদের। খুব কম সংখ্যক নারীরা রাধে ও বাঁধে এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। এর মধ্যে যারা শুধুমাত্র গৃহিণী এবং নিজের সন্তান-সন্তানিদের লালন পালন করছেন। তাদের ক্ষেত্রে বাঁধে শব্দের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগই হয়ে ওঠেনা। আজ সেই সব গৃহিণীদের জন্য অসীম সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সুরাইয়া খানম লিলি নামে এক গৃহিণী। সদ্য শেষ হওয়া চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা একটি দুটি নয় তিনটি উপজেলা। লোহাগাড়া সাতকানিয়া ও বাঁশখালী। তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী করেছেন হেভিওয়েট বাঘিনীরা। তিনিই একমাত্র সরাসরি রান্নাঘর থেকে জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী করে এক ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন
কে এই সাহসী সুরিয়া খানম লিলি?
লোহাগাড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগে সভাপতি রিদওয়ানুল হক সুজনের সহধর্মিনী সুরাইয়া হক লিলি। তাঁর স্বামী আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ । সুজনের সাথে আলাপকালে বলেন ২০০৩ সালে আমিরাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বার আলিয়া ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লোহাগাড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের ঘরে এক মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যায়নরত ছেলে প্রথম শ্রেণীতে সর্বশেষ এক বছর পূর্ণ হয়েছে তার ছেলে সন্তান শেষটা।
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। নির্বাচন করার সিদ্ধান্তটা প্রথম এবং কিভাবে আসে। জবাবে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রস্তাব দেন। তিনি প্রস্তাব পেয়ে, নির্বাচন করার করার জন্য বলেন। নির্বাচনে জয় লাভে আনন্দ স্বাভাবিক।
তবে একজন গৃহিণী হয়ে বাঘিনীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী করে জয় লাভের উচ্ছ্বাস কেমন? জবাবে লিলি বলেন , আমি একজন গৃহিণী হলেও আমার স্বামীর রাজনীতির সাথে সর্বক্ষেত্রে সংযুক্ত ছিলাম। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পর্দার আড়ালে সব করে যাচ্ছি। তাছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে মহিলাদের বিভিন্ন বৈঠক থেকে প্রচার প্রচারণায় এবং সরকারি বিভিন্ন অনুদান বিলিবন্টনে সবকিছুতে আমার পদচারণ আছে।
প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি চাই আমার মত গৃহিনী থেকে শুরু করে সকল নারীরা সমাজ ও দেশ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা প্রতিযোগিতা করুক। এতে আমাদের দেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে যেমন দাঁড়াবে তেমনি আমাদের আগামী প্রজন্ম একটি উন্নত রাষ্ট্র পাবে। নির্বাচনে ভোটারদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সে ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে যে উন্নয়ন পাব তার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আরও বেশি বরাদ্দ নিয়ে আসার চেষ্টা করব অর্থাৎ আমি দেখাতে চাই স্বাভাবিক উন্নয়নে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করে অধিক থেকে অধিকতর উন্নয়ন করার চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। বর্তমান সরকার নারীদের যে অগ্রাধিকার দিচ্ছে তা যদি নারীরা ভোগ করতে না পারে এতে নারীদের ব্যর্থতা। নারীদের শুধু রাঁধলে হবে না। সব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। আমার পরিকল্পনার মধ্যে নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে একাধিক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বাল্যবিবাহ বন্ধ, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা সহ নারীদের নিয়ে ইত্যাদি কাজ করার ইচ্ছে আছে। যে সকল নারী শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কিন্তু গৃহিণী, তিন চার বাচ্চার মা হয়ে শুধু চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। তাঁরা সংসারে কাজ করে অনেক অলস সময় থাকে। এই সময়ে নিজকে ব্যস্ত রেখে সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। এক বছরের বাচ্চা নিয়ে তিনটি উপজেলায় নির্বাচন যেমন সম্পন্ন করেছি তেমনি জেলা পরিষদে শতভাগ দায়িত্ব পালন করতে পারবো।
উল্লেখ,১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৯১ ভোট পেয়ে মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন সুরাইয়া খানম লিলি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য শাহিদা আক্তার জাহান ১৯০ ভোট পেয়েছেন।