বিএনপির গণসমাবেশ

বরিশালে মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপি-আ.লীগ

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২২, ০২:৫৭ পিএম
বরিশালে মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপি-আ.লীগ
  • গণসমাবেশের বাকি মাত্র এক দিন
  • পরিবহনের পর এবার লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ
  • দুই দিন আগেই বরিশালে পৌঁছে গেছেন অনেক নেতাকর্মীরা
  • আবাসিক হোটেলে পুলিশের অভিযান
  • ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে বরিশাল নগরী
  • মিছিল-শ্লোগানে সরগরম বরিশাল

বরিশালে বিএনপি’র বিভাগীয় গনসমাবেশের বাকি মাত্র আর এক দিন। বাস বন্ধের ঘোষণার পর এবার বরিশাল-ভোলা সহ বেশ কয়েকটি রুটের লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) সকাল থেকে বরিশাল নদীবন্দর ও ডিসি ঘাট থেকে কোনো লঞ্চ ও স্পিডবোট ভোলার উদ্দেশ্যে যাত্রীদের নিয়ে ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি। তেমনি ভোলা থেকেও কোনো নৌযান বরিশালে আসেনি।

এদিকে বুধবার রাতে বরিশালের আবাসিক হোটেল গুলোতে পুলিশের অভিযান চালাতে দেখা গেছে। বাস, লঞ্চ, স্পীড বোর্ড বন্ধ ঘোষনার খবর পেয়েই দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে কয়েক হাজার নেতাকর্মীরা বুধবার ও বৃহস্পতিবার বরিশালে অবস্থান করেছেন সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য। এছাড়াও বুধাবার রাত সমাবেশস্থলে রাত যাপন করেছেন নেতাকর্মীরা। এদিকে লক্ষ করা গেছে সমাবেশকে কেন্দ্র করে বরিশালে বিএনপি-আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। ৫ নভেম্বরের বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করতে রাজপথে নেমেছে বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। গত কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মিছিল, গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছেন তারা।

অপরদিকে ১১ নভেম্বর ঢাকায় যুবলীগের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ সফল করতে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বরিশালে প্রতিদিন সব ওয়ার্ডে মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে যুবলীগ। তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার সন্ধ্যায় বরিশাল শ্রমিক লীগ ও মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রইজ আহম্মেদ মান্নার উদ্যোগে ছাত্রলীগের বিশাল এক মটর সাইকেল শোডাউন দেওয়া হয়। একই সময় প্রধান দুই দল রাজপথে থাকায় বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা করছে নগরবাসী।

বিএনপির দাবি, তাদের গণসমাবেশ ব্যাহত করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কর্মসূচি দিয়েছে যুবলীগ। তবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ সফলের লক্ষ্যে তৃণমূল উজ্জীবিত রাখতে এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি আওয়ামী লীগের। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলাকালে গত সোমবার নগরীর কালীপুর এলাকায় ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় যুবলীগের বিরুদ্ধে। আগামী ৫ নভেম্বর বিভাগীয় গণসমাবেশ উপলক্ষে বিএনপি এবং কেন্দ্রীয় সমাবেশ সফল করতে যুবলীগ রাজপথে থাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘাত হতে পারে বলে আশঙ্কা জনসাধারণের। তবে কোনো সংঘাতের উদ্দেশ্যে নয়, কেন্দ্রীয় সমাবেশ উপলক্ষে তৃণমূল যুবলীগ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সকল ওয়ার্ডে যুবলীগের মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে বলে দাবি মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বাবুর।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক দল। এই দলের সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি গণতান্ত্রিক। অভিযোগ করা বিএনপির অভ্যাস। শুধুমাত্র অভিযোগ করার জন্যই তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।

এদিকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির বলেন, তারা ৪ ও ৫ নভেম্বর বাস-লঞ্চ এবং থ্রি হুইলার, স্পীড বোর্ড বন্ধ করেছে। বিএনপির গণসমাবেশের প্রাক্কালে তারা (আওয়ামী লীগ) প্রতিদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মিছিল করছে। পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া কিংবা সংঘাতের উদ্দেশ্যেই তারা এই কর্মসূচি নিয়েছে। তবে বিএনপি এসব এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছে। ৫ নভেম্বর জনস্রোতে সব বাধা উড়ে যাবে বলে দাবি করেন তিনি।

লঞ্চ ও স্পিডবোট বন্ধ:
লঞ্চ ও স্পিডবোট মালিক সমিতি লঞ্চ বন্ধের কোনো কারণ না জানাতে পারলেও বিএনপি নেতারা বলছেন, ৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করেই নৌযানগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বরিশাল-ভোলা রুটে যাতায়াতাকারী নিয়মিত যাত্রীরা। লঞ্চ চলাচল বন্ধের বিষয়ে মালিক সমিতি কিছু না জানালেও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিদর্শক কবির হোসেন জানান, ভোলায় আওলাদ নামক একটি লঞ্চে বুধবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুধু ভোলা রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে মেহেন্দিগঞ্জ ও মজুচৌধুরীরহাট রুটের লঞ্চগুলো বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত চলাচল করছে। এদিকে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ভোলা-বরিশাল নৌ রুটে যাত্রীবাহী স্পিড বোট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা।

আবাসিক হোটেলে পুলিশের অভিযান:
নগরীর আবাসিক হোটেলগুলোর ‘খোঁজ-খবর’ নিতে শুরু করেছে পুলিশ। হোটেল মালিকরা বলছেন, নতুন করে বোর্ডার বা অতিথি তোলার ক্ষেত্রে প্রশাসন থেকে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, নিয়মিত তদারকির অংশ হিসেবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় মালিক সমিতির আওতায় দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। মালিক সমিতি কয়েক বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। সমিতির সাবেক দায়িত্বশীলরা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। 

জানা গেছে, বুধবার শহরের বেশ কিছু হোটেলে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সন্ধ্যায় হোটেল রোদেলা ইন্টারন্যাশনাল ও কাঠপট্টি রোডের হোটেল ধানসিঁড়ি পরিদর্শন করেন। এই খবরে অন্য হোটেলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ‘পুলিশি অভিযানের’। বিএনপির কয়েকজন নেতাও এমন এই অভিযোগ করেন। 

হোটেল রোদেলা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক সৈকত হোসেন বলেন, পুলিশ সদস্যরা এসেছিলেন। তবে আমাদের কিছু বলেননি। তারা এসে কিছুক্ষণ বসে আবার চলে গেছেন। হোটেল মালিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, নতুন বোর্ডার নিতে পারব না এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে প্রশাসন থেকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, কক্ষ ভাড়া দেওয়ার যে নীতিমালা রয়েছে তা যেন অনুসরণ করা হয়। তিনি বলেন, ভাড়া যিনি নেবেন তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি তুলে রাখাসহ হালনাগাদ তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখতে বলা হয়েছে। 

কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিমুল করিম বলেন, হোটেল তদারকি আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ। হোটেল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নিয়ম অনুসরণ করছেন কি না এসব খোঁজখবর নিতেই হোটেলে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ফজলুল করিম বলেন, আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো একটি নিয়মিত বিষয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা থাকবেন হোটেলে, সেটা কোনো সমস্যা নয়। আমরা অভিযান চালিয়েছি কোনো চোর, বাটপার বা ছিনতাইকারী হোটেলে আছে কিনা সেই খোঁজ নিতে।

বঙ্গবন্ধু উদ্যানের একাংশে চলছে মঞ্চ নির্মাণের কাজ:
গনসমাবেশ করার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের একাংশে সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়ার পর থেকেই দিন রাত বঙ্গবন্ধু উদ্যানের একাংশে মঞ্চ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যেতে দেখা গেছে।

সমাবেশে যোগ দিতে বরিশালে পৌঁছে গেছেন অনেক নেতাকর্মী: 
গণসমাবেশে যোগ দিতে বিভাগের ৬ জেলা থেকে অধিকাংশ নেতাকর্মী ইতোমধ্যে বরিশালে পৌঁছে গেছেন। এছাড়া আজ এবং আগামীকাল শনিবার আরো নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেবেন। আত্মীয় স্বজন এবং আবাসিক হোটেলে তারা অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বুধবার রাতে ভোলা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে বলে দাবী করেন বিএনপি নেতারা। অবশ্য এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে কোনো লাভ হবে না, ৬৫ শতাংশ নেতাকর্মী ইতোমধ্যে বরিশাল শহরে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলছেন, প্রয়োজনে নেতাকর্মীরা নৌপথে-ট্রলারে ও সড়কে বাইসাইকেলে করে আসবেন, আর তাতেও সমস্যা হলে হেঁটে আসবেন।

ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে বরিশাল নগরী: 
গনসমাবেশের বাকি আর মাত্র এক দিন। আর এই সমাবেশ উপলক্ষে সমাবেশস্থল সহ  বরিশাল জেলা ও মহানগর দলীয় কার্যালয়ের সামনে যেন ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুনের উৎসব চলছে। ঢাকা বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর থেকে বরিশাল সমাবেশস্থল পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশ, ভবনের দেয়াল আর ল্যাম্পপোস্টের লাগানো হচ্ছে ব্যানার। রঙ-বেরঙের এসব ফেস্টুন ব্যানারে শোভা পাচ্ছে দলের কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি দাবির কথা। এছাড়া গনসমাবেশের সফলতা কামনা করেও টানানো হয়েছে অসংখ্য পোস্টার। কেন্দ্রীয় নেতা কর্মীরা হচ্ছে নগরীতে লিফলেট বিতরন করছেন। এদিকে ৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের কারণেই বন্ধ করা হয়েছে লঞ্চ ও স্পিডবোট এমনটাই বলছেন বিএনপির নেতারা।

মিছিল-শ্লোগানে সরগরম বরিশাল:
সমাবেশকে সামনে রেখে মিছিল ও শ্লোগানে সরগরম হয়ে উঠছে বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যান (বেলস পার্ক)। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দলে দলে নেতাকর্মীদের আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। মেহেন্দগঞ্জ, ভোলা, দৌলতখান উপজেলা, পটুয়াখালী, গলাচিপা, বরগুনা, কুয়াকাটা থেকে আসা নেতাকর্মীরা জানান, বাস চলাচল বন্ধ থাকায় দুদিন আগেই বরিশালে এসেছি। কোনো হোটেল খালি না থাকায় সমাবেশ মাঠেই অবস্থান করলাম। তবে লক্ষ করা গেছে সমাবেশস্থলে থাকা নেতাকর্মীরা কিছুক্ষন পর পরই বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছে। বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলসিক জাহান শিরিন বলেন, কোনো কিছুতেই বরিশালের গণসমাবেশে জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। প্রয়োজনে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ পায়ে হেটে, সাইকেলে, ট্রলার ও নৌকায় চেপে আসবেন। যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, শো ডাউন করে বরিশালে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। তারা বেপরোয়া হয়ে গেছেন বিএনপির জনসমর্থন দেখে। আমাদের নেতাকর্মীদেরকে যদি হোটেলে থাকতে দেওয়া না হয় সমাবেশস্থলে থাকবেন তারা। লাখ লাখ মানুষ সমাবেশস্থলে সমবেত হবেন।

কেএস