শান্তি চুক্তির ২৫ বছরের বদলে গেছে পাহাড়ের দৃশ্যপট খুন, গুম, অপহরণ, আদিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জাতিগত ভেদাভেদ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিবেশের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনমান। নীরবে চলছে চার গ্রুপের চাঁদাবাজি
শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি। ১৯৯৭ সালের এই দিনে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
দিবসটি পালনে ২ ডিসেম্বর শুত্রুবার ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তি রজত জয়ন্তী যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপনে নানা অনুষ্ঠান কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন। কর্মসূচিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং কেক কাটা, আলোচনা সভা, রোড শো, ব্যানার-ফেস্টুন-ডিজিটাল ডিসপ্লে, চুক্তি পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় নানা উন্নয়ন বিষয়ক প্রচার-প্রচারণা, স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা বিকালে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সম্প্রপ্রীতি কনসার্ট ও ফানুস ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পার্বত্য চুক্তির ফলে পুরোপুরি শান্তি না মিললেও বদলে গেছে পাহাড়ের দৃশ্য। দীর্ঘ প্রায় ২ দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এক সময়ের দুর্দান্ত প্রভাবশালী শান্তি বাহিনীর গেরিলাদের গায়ে শোভা পাচ্ছে পুলিশের পোশাক। চুক্তির ফলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসায় দূর পাহাড়ের বুক চিরে রাত-দিন ছুটছে যানবাহন। এক সময় জেলার বাইরের অন্য জেলার সঙ্গে ৩টার পর যোগাযোগ করার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে পাহাড়ের পর্যটন স্পট সাজেক ছিল আতঙ্কিত ও বিচ্ছিন্ন। যোগাযোগ ছিল নিষিদ্ধ। চুক্তির ফলে সেই সাজেক পর্যটন স্পট আজ পাহাড় ছেড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র সুনাম ছড়িয়েছে। গড়ে উঠেছে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ। প্রতিনিয়ত আসছে হাজার হাজার পর্যটক।
তবে অব্যাহত খুন, গুম, অপহরণ, আদিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জাতিগত ভেদাভেদ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিবেশের ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনমান। শান্তিচুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হলেও ভূমি জটিলতাসহ কয়েকটি ইস্যুতে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্য জেলাগুলোতে বিদ্যমান সশস্ত্র গ্রুপগুলোর আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে পাহাড়ের পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। নিজেদের স্বার্থে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি ভেঙে এখন চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। চার সংগঠনের আধিপত্য বিস্তারের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। পার্বত্য এলাকায় শান্তিচুক্তির পর যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছিল তাদের অধিকাংশই বাঙালি। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পাহাড়ি। বাঙালিরা খুন হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে। অন্যদিকে পাহাড়িদের অধিকাংশই নিহত হয়েছে দলীয় কোন্দলের কারণে।
১৯৯৭ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়। যে চুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। কিন্তু এই চুক্তির ২৫ বছর পার হলেও পাহাড়ে এখনও পুরোপুরি শান্তি ফেরেনি। এখনও ঘটছে গোলাগুলি, রক্তক্ষয়ী সংঘাত, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। শান্তিচুক্তির বছর যেতে না যেতে প্রতিষ্ঠা হয় চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকেই শুরু হয় পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। থেমে থেমে চলে দুই সংগঠনের হত্যা-পাল্টাহত্যা। ২০০১ সালে তিন বিদেশি অপহরণের মাধ্যমে শুরু হয় পাহাড়ে অপহরণ বাণিজ্য। পরে ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে ২০১০ সালে আরেক আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে এসে ইউপিডিএফ থেকে বের হয়ে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়। যেটি ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পরিচিত। এরপর বিভিন্ন সময় চার পক্ষের কর্মী-সমর্থক হত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, গত এক বছরে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে পাহাড়ে অর্ধশতাধিক মৃত্যু হয়েছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে চার পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের হত্যা চললেও এ সময় পাহাড়ে ১৯৯৭ সালের আগের চেয়ে অনেকটা শান্তি স্থাপন হয়।
সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চুক্তির ফলে কাঙ্খিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে ও পাহাড়ে চার গ্রুপের চাঁদাবাজির কারণে সরকারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেদিকে। সরকারকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
পাহাড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হয়েছে বিশ্ববাসির কাছে পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটনও ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। কিন্তু চুক্তির এত বছর পর এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য ‘জেএসএস’ সরকারকে দোষারোপ করতে দেখা গেছে। ধারা বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে দুপক্ষের তর্কযুদ্ধ। এই ২৪ বছর ধরে ‘জেএসএস’ চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে বেশিরভাগ সময় সক্রিয় ছিল। পক্ষান্তরে ইউপিডিএফ সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্যাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে জেএসএস (সংস্কারপন্থি) পক্ষও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে লিপ্ত রয়েছে। তবে চুক্তি নিয়ে তেমন কোনো কথা এখনও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) পক্ষ থেকে শোনা যায়নি।
গত ২৫ বছরে খাগড়াছড়িতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। জেলাবাসীর বিদ্যুৎতের চাহিদা মেটাতে ঠাকুরছড়া, ১৩২ কেভি পাওয়াগ্রিড নির্মাণ করা হয়েছে। সরকার দুর্গম এলাকায় যেখানে অন্ধকার ছিল সেখানে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সব মানুষকে আলোর মূখ দেখিয়েছে, ১০ হাজার পরিবারকে সৌর বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে।তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি,রাঙ্গামাটি, বান্দরবান আরও ৪০ হাজার পরিবারকে বিদ্যুতের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়,রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, খাগড়াছড়ি প্রাইমারি শিক্ষকদের ট্রেনিং সেন্টার পিটিআই সেন্টার, রাঙামাটি নার্সিং কলেজ, রাঙামাটি কৃষি ডিপ্লোমা কলেজ, খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ,খাগড়াছড়ি হাসপাতাল ভবন, উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন, জেলার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম,খাগড়াছড়ি ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য তিন জেলার ২৬টি উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চুক্তির আগে পাহাড়ের দুর্গমাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম তেমন একটা না থাকলেও বর্তমানে জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। শিক্ষা, যোগাযোগ, কৃষিসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরির্বতন এসেছে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বেলি ব্রিজ এর পরিবর্তে নির্মাণ করা হয়েছে পিসি গার্ডার সেতু, আরসিসি সেতু ও আরসিসি বক্স কালভার্ট ৪২টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে খাগড়াছড়ি জেলার ৪১টি সেতুর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ৯টি, দীঘিনালায় ৫টি, পানছড়িতে ১০টি, মহালছড়িতে ৫টি, লক্ষ্মীছড়িতে ৪টি, মাটিরাঙ্গায় ৩টি, গুইমারায় ২টি, রামগড়ে ২টি, মানিকছড়ি ১টি ও রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি ১টি সেতু এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।এক সময় ৫০ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ ছিল। এখন তা ১ হাজার কিলোমিটার হয়েছে। যোগাযোগা ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দুর্গম পাহাড়ি জনপদের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানউন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু বলেছেন, শান্তিচুক্তির কারণেই পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাহাড়ের মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। দীর্ঘ প্রায় ২ দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পাহাড়ের জনগোষ্ঠিদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে।
ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, দীর্ঘ প্রায় ২ দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর শান্তি চুক্তির ২৫ বছরের বদলে গেছে পাহাড়ের দৃশ্যপট, শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহহীনদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহনির্মাণ, প্রত্যান্ত অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সৌর বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে প্রতিটি গ্রামের রাস্তা পাকা করা হয়েছে।রামগড় স্থলবন্দর এর মাধ্যমে ভারত এবং বাংলাদেশের। দু’দেশের পারস্পারিক সম্পর্ক ও ব্যবসায়িক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ফলের দারিদ্রতা দূর হয়েছে। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে জীবন যাত্রার মান্নোয়ন হয়েছে। সব কিছুই শান্তিচুক্তির ফসল
আঞ্চলিক পরিষদের নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীর্ঘ সময় পার হলেও চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ বিষয় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার বরং পার্বত্য চুক্তিবিরোধী বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে।দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০১৬সালে পার্বত্য চট্রগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সরকার ভূমি কমিশনের বিধিমালা ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে এদিকে সরকারপক্ষ বলেছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
কেএস