শুস্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে দেখা দেয় নাব্যতা সংকট। বিশেষ করে ঢাকা বরিশাল নৌরুটে অসংখ্য ডুবোচর থাকায় ব্যাহত হয় নৌ চলাচল। নাব্যতা সংকট দূর করতে গেল ডিসেম্বরে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দখিনের ২৮টি নদীর ৪৭টি পয়েন্টে ড্রেজিং শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ।
তবে খনন করা পলিবালি নদীতে ফেলার কারণে প্রতিদিন কী পরিমাণ অপসারণ করা হচ্ছে, তা-ও কেউ জানে না বা বলতে পারছে না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও টেকসই ড্রেজিং হচ্ছে না। শুধু প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অপরদিকে খননকৃত পলিবালু খরস্রোতা এলাকায় ফেলা হচ্ছে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি পলিবালু খনন এলাকায় এসে ভরাট হওয়ার সুযোগ নেই।
বর্ষায় দেশের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পায় আর শুষ্ক মৌসুমে তা কমে যায়, এটাই স্বাভাবিক বা প্রকৃতির নিয়ম। শুষ্ক মৌসুমে বরিশাল-ঢাকা নৌরুট সচল রাখতে প্রতি বছরই বিভিন্ন স্থানে ড্রেজিং বা খনন কাজ করে থাকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবে বছর বছর এমন ড্রেজিং নিয়ে আগে থেকেই যাত্রীবাহী নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের মতের ভিন্নতা রয়েছে। তাদের মতে এভাবে বছর বছর অস্থায়ীভাবে খনন কাজ না করে নৌপথে পরিকল্পিতভাবে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী খনন কাজ করার।
জানা যায়, পটুয়াখালী ও বরিশাল নদীবন্দর-সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদী, বরিশাল-ঢাকা রুটের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া, ভাসানচর, মেঘনা নদীর হিজলার মিয়ারচর ও মেহেন্দীগঞ্জের কালীগঞ্জ, পটুয়াখালী-ঢাকা নৌপথের লোহালিয়া, কবাই ও কারখানা নদীর বেশ কয়েকটি চ্যানেল, বরিশাল-ভোলা নৌপথের লাহারহাট-ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এলাকা, বরগুনার খাকদন, বিষখালীসহ বিভিন্ন নদীতে পলিবালি জমে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের একাধিক লঞ্চের মাস্টাররা জানান, দক্ষিণাঞ্চলে বেশিরভাগ নৌরুটে রয়েছে নাব্য-সংকট। পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য কমপক্ষে ১২ মিটার পানি থাকার নিয়ম রয়েছে। তবে এ পথে চলাচলকারী নৌযানগুলোর আকার অনুযায়ী আট মিটার হলেও নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো এলাকায় দুই-তিন মিটার পানি পাওয়া যায়। ফলে নির্ধারিত পথ বাদ দিয়ে অতিরিক্ত ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে সময় ও খরচ উভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা জানান, বরিশাল নৌবন্দর এলাকায় কীর্তনখোলা নদীতে দৈনিক দুই-তিন ঘণ্টা ড্রেজিং করা হয়। এজন্য ড্রেজিং বিভাগের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যখন খুশি তখন ড্রেজিং শুরু করে তারা। টার্মিনাল এলাকা থেকে লঞ্চগুলোকে নদীর মাঝে এসে নোঙর করতে হয় এবং জাহাজ এসে পড়লে সরিয়ে নিতে হয়। প্রতিদিন হয়রানির শিকার হই। অথচ রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর টার্মিনাল এলাকা খালি পড়ে থাকে। রাতে দুই-তিন ঘণ্টা ড্রেজিংয়ের কাজ করলে আমাদের এ ভোগান্তিতে পড়তে হয় না।
সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির পরিচালক সাইফুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ড্রেজিংয়ের সময় উত্তোলনকৃত পলিবালি একশ থেকে দেড়শ মিটার দূরে নদীতেই ফেলা হচ্ছে। নদীতে না ফেলে অন্যত্র ফেললে বছর বছর এ সমস্যার সৃষ্টি হতো না।
তিনি বলেন, আমরা লঞ্চমালিকরা নদীর বালি নদীতে না ফেলে নিকটবর্তী চরে ফেলার অনুরোধ করছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। ড্রেজিং বিভাগ তাদের ইচ্ছেমাফিক কাজ করছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও টেকসই ড্রেজিং হচ্ছে না। শুধু প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে।
নিজাম শিপিংয়ের মালিক নিজামুল ইসলাম ঢাকা-বরিশাল নৌরুট বাঁচাতে পরিকল্পিত ও টেকসই ড্রেজিং ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল মতিন সরকার জানান, নভেম্বর থেকে নাব্য-সংকট দেখা দেয়। সবচেয়ে সংকট দেখা দেয় ফেব্রুয়ারিতে। এ সময় নৌপথ সচল রাখতে ২০টির বেশি নদীর ৪৭টি এলাকায় ৩০ লাখ ঘনমিটার পলিবালি ড্রেজিং করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ১২টি ড্রেজার কাজ করছে।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, স্থান না পাওয়ায় পলিবালি কেটে নদীর গভীরে এবং খরগ্রোতা এলাকায় ফেলা হচ্ছে। তবে সেগুলো আবার খনন এলাকায় এসে ভরাট হওয়ার সুযোগ নেই বলে তার দাবি।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল মতিন সরকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পলিবালি অপসারণে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। ডিজিটাল ও ম্যানুয়াল দুই পদ্ধতিতে প্রতিদিনের হিসাব রাখা হচ্ছে। তারপরও যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখা হবে।
কেএস