ব্যবসায়িক হিসেব-নিকেশ খাতায় লেখার আগ্রহ থেকে ৬৫ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান নামের এক ব্যক্তি পুতির (নাতনির সন্তান) সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন। নিরক্ষর আব্দুল মান্নান এখন পুতি কাওসার (৫) এর সাথে নিয়মিত আসেন বিদ্যালয়ে। পড়া লেখা করেন প্রথম শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথেই। শিক্ষার্থী আব্দুল মান্নানের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়িতে। পড়েন একই ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সরেজমিনে কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের কাশিয়বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ধীরগতিতে রাস্তার একপাশ ধরে পুতির হাত ধরে বিদ্যালয়ে আসছেন মান্নান। দুজনের (পুতি ও জ্যাঠা) হাতেই হাতে আছে প্রথম শ্রেণির তিনটি বই, খাতা ও কলম। নির্বিগ্নে বিদ্যালয়ের মাঠ হয়ে শ্রেণি কক্ষে প্রবেশ করল মান্নান। একই মাঠের এক পাশেই রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। আর মান্নানের বিদ্যালয় মাঠে প্রবেশের সময় বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অন্তত এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল এদিন।
কিন্তু এমন বয়স্ক শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়গমনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি বিদ্যালয় মাঠ, এলাকায় কিংবা শ্রেণি কক্ষেও। এরপর ক্লাসে শ্রেণি শিক্ষক প্রবেশ করলে একবারেই কোমলমতি শিশুদের মতই বোর্ডে তাকিয়ে গনিত শিখছিল মান্নান। দাঁড়িয়ে পড়ছিল ১, ২, ৩। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোনো কমতি দেখা যায়নি বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরভী আক্তাতারের আচরণেও। তিনি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতই বইয়ে হাত রেখে শেখাচ্ছিলেন মান্নানকে।
এসময় শ্রেণি শিক্ষক সুরভি আকতার জানান, এত বয়সি একজন মানুষ শেখার জন্য ভর্তি হয়েছেন। তবে, ক্লাসে পড়ালেখার সময় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছেনা। মান্নান চাচাও ছোট বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে পড়ালেখা করছে। আমি আশা করছি তার দিন দিন শেখার ক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে। উনি পারবে।
শুধু শ্রেণি কক্ষেই থেমে থাকেননি বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান। ক্লাস শেষে তিনি অংশ নিয়েছেন বিদ্যায়ের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায়। মঞ্চে উঠে মাইক্রফোন হাতে তিনি আবৃতি করেছেন পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সেই বিখ্যাত কবিতা "আসমানি"। শেষে দুটি কথায় জানান দেন কবিতাখানি তিনি তার চাচার কাছ থেকে শিখেছিলেন। এসময় বিচারক, অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ হাজারো উপস্থিত জনতা তাকে করতালি দিয়ে সাদুবাদ জানান।
সহজ সরল ও নিরব প্রকৃতির মানুষ আব্দুল মান্নান জানান, কোনমতে পানের দোকান করে বাঁচি আছি। কেবল বাকি লেখা শেখার আগ্রহ থেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তিনি। তার অগাত বিশ্বাস তিনি পারবেন, পারতেই হবে তাকে। শিক্ষার বয়সকে কোনো ফ্রেমে বাঁধা যায়না, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখন আব্দুল মান্নান।
কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান মিথুন মন্ডল আমার সংবাদকে বলেন, প্রথম প্রথম বাচ্চারা হাসাহাসি করলেও এখন আর কোনো সমেস্যা নেই। তিনি নিয়মিত স্কুলে আসে, মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করে। শ্রেণি কক্ষে এর খারাপ কোনো প্রভাব পড়ছে না। মান্নান চাচা এখন আমাদের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতই একজন ছাত্র। আমরা তাকে শেখানোর ক্ষেত্রে অনেকটাই চেষ্টা করছি।
কেএস