মুসল্লীদের আকর্ষণ গোসাইরহাটের জ্বীনের মসজিদ

নয়ন দাস, গোসাইরহাট প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২৩, ০১:০০ পিএম
মুসল্লীদের আকর্ষণ গোসাইরহাটের জ্বীনের মসজিদ

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের শিবপুরে অবস্থিত তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদ। প্রচলিত নামের বাইরে এলাকাবাসীর কাছে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত সাড়ে চারশ বছরের মসজিদটি। মসজিদটি মুসল্লীদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। 

সরেজমিনে আমার সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় মসজিদ কমিটির সভাপতি, ইমাম ও স্থানীয় প্রবীণ মুসল্লীদের। স্থানীয় প্রবীণ মুসল্লীরা মসজিদটি নিমার্ণের ইতিহাস সম্পর্কে জানিয়েছেন, মসজিদের নাম তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদ হলেও সাড়ে চার শত বছরের পুরোনো মসজিদটি জ্বীনের মসজিদ নামেই পরিচিত।

জনশ্রুতি রয়েছে মসজিদটি কোনো মানুষের নকশা ও শ্রমিকের শ্রমে গড়ে ওঠেনি। মসজিদটি বর্তমানে যে স্থানে অবস্থিত সে স্থানে মসজিদ হওয়ার আগে অথৈ পানি ছিল। এক রাতের মধ্যে পানির ভেতর মাটি ফেলে মোঘল কারুকার্য খচিত নান্দনিক ডিজাইনে এরকম সুন্দর মসজিদ নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রবীণরা আরও জানান, বাপ-দাদাদের থেকে শুনেছি মসজিদটি নির্মাণ হওয়ার পর জ্বীনদের ভয়ে ৫০-৬০ বছর ঐ মসজিদে কেউ নামাজ পড়তে যাননি।

ঐ সময়ে মসজিদের কাছে কোনো বসত বাড়ি ছিল না। পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদ এলাকায় বসত বাড়ি নির্মাণ হলে মানুষের ভয় আস্তে আস্তে কাটতে থাকে। তখন মানুষ জ্বীনের মসজিদটিতে নামাজ পড়া শুরু করলেও অধিকাংশ সময় নামাজের জামায়াতে অপরিচিত মানুষ দেখা যেত। 

প্রবীণরা দাবি করেন, জ্বীনদের মসজিদ নির্মাণ কাজ যখন প্রায় শেষ তখন ভোর রাত। ভোর রাতের দিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক ব্যক্তি মসজিদ নির্মাণের কাছাকাছি মাছ ধরতে গেলে জ্বীনেরা মসজিদ নির্মাণ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। এই কারণে কিছু কাজ এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়ে গেছে। মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা যায়, পাঁচ কাঠা জমির ওপর স্থাপিত চতুর্ভূজ আকৃতির মসজিদটি এক গম্মুজ বিশিষ্ট। মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার বা সারি রয়েছে। প্রতি কাতারে ১০ জন করে মোট ৩০ জন ব্যক্তি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। 

মসজিদের সামনের দিকে সাড়ে চারশত বছরের পুরোনো একটি পাকা মাঠ রয়েছে। মুসল্লী সংখ্যা মসজিদটির ধারণ ক্ষমতার বেশি হলে মাঠটিতে মুসল্লীরা নামাজ পড়তে পারেন। এছাড়াও মসজিদের আঙ্গিনা ঘেঁষা পুকুরটিতে মসজিদ সম পরিমাণ বয়সী একটি সাঁন বাঁধানো ঘাট রয়েছে মুসল্লীদের ওযু করার জন্য। পুরোনো কোনো নাম ফলক বা ইতিহাস থেকে মসজিদটির নির্মাণসাল জানা যায়নি। 

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর গবেষণা করলে হয়তো নির্মাণসাল পাওয়া যাবে। প্রত্যন্ত গ্রাম ও বাগান বাড়ির মধ্যে মসজিদটির অবস্থান হওয়ায় অদৃশ্য ভয়ে যোহর ও আছর নামাজের সময় এখনো লোক সমাগম কম হয়। মোঘল কারুকার্য খচিত নান্দনিক ডিজাইনের কারণে দূর-দূরান্তের অনেকেই দেখতে আসে জ্বীনের মসজিদটি। 

আব্দুল হালেম মৃধা (৫০) নামে এক মুসল্লী বলেন, ভয়-ডর লাগে না। জ্বীনের মসজিদ সবাই বলে। আমরা ছোটবেলা থেকে এই মসজিদেই নামাজ পড়ি। ছোট থেকে সবার কাছে শুনে আসছি এটা জ্বীনের তৈরী মসজিদ। মুরব্বিরা আগে জ্বীন দেখেছে। এখন আর দেখা যায় না। 

জ্বীনের মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম বেপারী বলেন, আমি জ্বীনের মসজিদে ৩০ বছর ধরে ইমামতি করি। ইমামতি করতে খুব আরাম লাগে। এখন গরমের সময়। মসজিদের ভেতর ঢুকলে সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শীতের সময় ভেতরে গেলেই গরম লাগে। আমাদের গত হওয়া বাবা, দাদা, পূর্বপুরুষদের থেকে শুনেছি মসজিদটি জ্বীন নাকি মানুষ তৈরী করেছে তা তারা কেউ জানত না। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ একথাও বলেছেন যে তারা বাপ-দাদার থেকে শুনেছেন মসজিদটি জ্বীনেরা তৈরী করেছেন। অত্র এলাকাসহ অনেক দূরের লোক এখানে আসে জ্বীনের মসজিদে নামাজ পড়তে। আমরাও এটাকে জ্বীনের মসজিদ বলেই জানি। এই গ্রামের সব মানুষ এখানে জুম্মা, তারাবি নামাজ পড়তে আসে।

জ্বীনের মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুস সালাম তালুকদার বলেন, মসজিদটির বয়স আনুমানিক চারশত-সাড়ে চারশত বছরের মতো হবে। মুরব্বিদের থেকে শুনেছি এই মসজিদ জ্বীনেরা তৈরী করেছে। এখানে একজন হাফেজ সাহেব ছিলেন দীর্ঘ ২৭-২৮ বছর। তিনি রাতে জ্বীনদের নামাজ পড়তে দেখেছেন। তিনি বলেছেন এখানে জ্বীনেরা নামাজ পড়ে। আমরা রাতে একটা ভিন্ন রকম অপরিচিত শব্দ শুনতাম। এই শব্দকে জ্বীনের শব্দ ধরে নিয়ে অনেকে মসজিদটিকে জ্বীনের মসজিদ বলেন। কয়েক বছর আগেও মসজিদের ভেতরে কোনো কথা বললে কথাটি আবার ফেরত (রিপিট) আসত। ভেতরে হালকা কাজ সংস্কার করার প্রয়োজনে আমরা সংস্কার করেছিলাম। এরপর থেকে কথা আর ফেরত আসে না। 

তিনি আরও বলেন, আগে যে ডিজাইন ছিল। তা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কয়েক শত বছর হয়ে গেছে মসজিদটির। যদি সরকারি ভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করত তাহলে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ আরও কয়েক শত বছর টিকে থাকত।

এমএইচআর