মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণার নাম হাম-হাম। যান্ত্রিক শহরে জীবনে ব্যস্ততায় হাঁপিয়ে ওঠা প্রকৃতি প্রেমীরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ছুটে যান পাহাড়, ছড়া আর ঝরণার টানে। এমনই একটি জলপ্রপাত হামহাম, যা প্রকৃতি প্রেমী ও এডভেঞ্চার প্রিয়দের কাছে অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান।
ভয়ংকর দুর্গম আর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত এই জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পদে পদে যেমন রয়েছে বিপদের ভয়, তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি। রোমাঞ্চের টানেই পাহাড় ও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আকর্যণীয় স্থান হামহাম জলপ্রপাত। স্থানীয় অনেকের কাছে যা চিতা ঝর্ণা নামে পরিচিত।
উঁচু পাহাড় গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ পানির ধারা প্রায় ১৩৫/১৫০ ফুট উপর থেকে। নির্জন পাহাড়ের ওপর থেকে আছড়ে পড়া স্রোতধারার শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। চোখ জুড়ানো দৃশ্যের পর্যটন কেন্দ্রটি হচ্ছে হামহাম জলপ্রপাত।
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে ইসলামপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাজাকান্দি রেঞ্জের ৭ হাজার ৯৭০ একর আয়তনের কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিম দিকে চম্পারায় চা-বাগান। কুরমা বনবিটের প্রায় ৮ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টি নন্দন এ হাম-হাম জলপ্রপাতটি অবস্থিত।
যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় সীমান্ত নিকটবর্তী গহীন অরণ্যে অবস্থিত হওয়া এই জলপ্রপাতটি ২০১০ সালের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। সেই থেকেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে।
আকর্ষণীয় এই জলপ্রপাতটিতে সরাসরি যাবার কোন সড়ক বা ব্যবস্থা নেই। কমলগঞ্জ উপজেলা চৌমুহনা চত্বর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত ২৫ কিঃমিঃ পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস/জিপ/ মাইক্রোবাসে করে যেতে পারলেও বাকি পথ পাহাড়ি এলাকা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পায়ে হেঁটে এ রাস্তায় যেতে যেতে চোখ পড়বে চা-বাগানের অপূর্ব দৃশ্য।
তবে মোটর সাইকেল বা সি.এন.জি-তে করে গেলে আরও ৪/৫ কিঃমিঃ ভেতরে সীমান্ত ঘেঁষে ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল্লী ও কুরমা বন বিটের অরণ্য ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে মূল জলপ্রপাত ৮ কিঃমিঃ দূরে।
হাম-হাম জলপ্রপাতে পর্যটকদের গহীন অরণ্য প্রবেশ করে জলপ্রপাত দেখতে হলে তৈলংবাড়ি বা কলাবন বস্তীর আদিবাসীদের সাহায্য নিতে হবে। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কষ্টের। পিচ্ছিল রাস্তার সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়। পেরোতে হয় দুর্গম পাহাড়ি সরু পথ, ট্রেকিং কালে সবাইকে ভারসাম্য রক্ষর্থে বাঁশের লাঠি হাতে করে নিতে হয়।
কদম, জারুল আর চিকরাশির সারিবদ্ধ ডালে পাখি আর প্রজাপতির মেলা কাউকে নিয়ে যাবে সভ্যতা থেকে বহু দূর। চলার পথে ডুমুরের গাছ আর বেত বাগানে দেখা মিলবে চশমা বানরের।জলপ্রপাতের অর্ধ-কিঃমিঃ দূর থেকেই শুনা যায় ঝর্ণার জলধ্বনী। শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণার পানি কম থাকলেও বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে যায়।
স্থানীয় উপজাতিদের ভাষা অনুসারে হাম হাম কথাটির অর্থ হচ্ছে প্রবল বেগে জোরে পানি পড়ার শব্দ। এ থেকেই এর নাম হাম-হাম হয়েছে। হাম-হাম যাবার পথে মাকাম নামের বেশ বড় একটা পাহাড়ও পাড়ি দিতে হয়। জলপ্রপাতে যাওয়ার পথে বেশকিছু উঁচু-নিচু পাহাড়, বন, পিচ্ছিল এলাকা পার হতে হবে। তাই ট্রেকিং উপযোগী জুতা পরতে হবে এবং সতর্ক হয়ে পথ চলবেন। মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা অনেক কঠিন হবে।
পায়ে হেঁটে জলপ্রপাতটিতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। পাহাড়ি ঝিরি ধরে হাঁটতে হয় বহু দূর। ঝিরিপথে পড়বে কখনও হাঁটু কিংবা কোমর পানি। ধারণা করা হয় বাংলাদেশে অবস্থিত অন্যান্য জলপ্রপাতের তুলনায় এটি সবচেয়ে প্রশস্ততম। প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত বিশিষ্ট এবং ১৩৫/১৫০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ জলপ্রপাতটি।
দিন দিন রোমাঞ্চকর অভিযাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত পর্যটক সংখ্যা বাড়ছেই। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়াতে বেশ কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশ নিঃসন্দেহে একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান রূপনিবে।
এ বিষয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত উদ্দিন বলেন, এটি সম্পূর্ণরূপে অ্যাডভেঞ্চার প্রকৃতির পর্যটনকেন্দ্র। আমাদের চিন্তা ভাবনা আছে কাজ করার। আপাতত এখানে উন্নয়নমূলক কোনো কাজ হচ্ছে না।তবে বনের ভেতর যাতায়াতের উন্নয়নের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।
যেভাবে পৌঁছাবেন-
ঢাকা থেকে হাম-হাম যেতে হলে শ্রীমঙ্গল হয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কালনি, পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে প্রথমে শ্রীমঙ্গল বা ভানুগাছ আসা যায়। তবে সব ট্রেন ভানুগাছ ষ্টেশন থামেনা, এজন্য শ্রীমঙ্গলই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন পর্যটকরা। ঢাকা থেকে ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা।
আর বাসে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে হানিফ/শ্যামলী পরিবহন, এনা পরিবহনের এসি ও ননএসি বাস পাওয়া যায়। বাসে করে শ্রীমঙ্গল যেতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। তারপর যেকোন গাড়ি নিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলায়, সেখান থেকে দ্রুত হাম-হাম পৌঁছানো যায়। আপনিও দেখে যেতে পারেন দেশের সবচেয়ে প্রসস্ত চিতা ঝর্ণা `হাম-হাম জলপ্রপাত`।
এইচআর