বান্দরবানের লামা উপজেলায় গত বুধবার থেকে টানা ৭ দিনের বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সৃষ্ট বন্যার পানি গত মঙ্গলবার রাত থেকে নামতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
ততক্ষণে ঢলের পানিতে প্লাবিত ও পাহাড় ধসে পৌরসভা এলাকাসহ ৭টি ইউনিয়নে প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৭০০টি বসতঘর আংশিক এবং সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মধ্যে পৌর শহরের ৫০০টি দোকান, একটি খাদ্য গুদাম ও ৬০০টি বসতঘর রয়েছে। ৭টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬শ ঘর।
স্থানীয়রা জানান, লামা উপজেলায় বিগত দিনে সবচেয়ে বড় বন্যা দেখা গিয়েছিল ১৯৮৭ ও ১৯৯৭ সালে এবারে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি ১৯৮৭ সালে বড় বন্যার চেয়ে এবার সাড়ে ৩ ফুট পানি বেশি উঠেছে। চারদিনের স্থায়ী বন্যায় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল ৭ আগস্ট সোমবার ওই দিন মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা ১১.৯৬ সেমি. এর উপর দিয়ে ৬ ফুট উচু হয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।
বন্যার পানিতে বহু মানুষের ঘর বাড়ি, গরু, ছাগল ভেসে গেছে। বাড়ির ছাদে আটকে থাকা অনেক পরিবারকে টিন কেটে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসে লামা উপজেলা প্রশাসন ও সেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়োজিতরা।
জানা গেছে, এবারের বন্যায় উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী বাজার পাড়া এলাকায় মঙ্গলবার সকালে আবুল হোসেনের স্ত্রী করিমা বেগম (৩৫) ঘরের মাটির দেয়াল চাপা গড়ে মারা গেছে এবং একই দিন দুপুরে ৬ নং রূপসীপাড়া ইউনিয়নের এক উপজাতি লোক নদী পার হতে গিয়ে ভেসে যাওয়ায় পানিতে ডুবে মারা গেছে। এছাড়া ঘর বাড়িতে গাছ ভেঙ্গে পড়ে এবং পাহাড় ধসে ১৫ জনের অধিক লোক আহত হয়েছে লামা পৌর শহরের মত ৭টি ইউনিয়নে একই ভাবে আঘাত হেনেছে বন্যা ও পাহাড় ধস। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সকল ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
লামা বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে যেখানে মালামাল রেখেছিলাম, সেখানে হানা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যার পানি। কোনভাবে মালামাল বাঁচানো যায়নি। লামা বাজারের প্রতিটি ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: মনিরুল ইসলাম জানান, লামার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যায় প্রাথমিক হিসাব মতে এক হাজার ঘরবাড়ি বিধস্ত হয়েছে, প্রায় ৩ হাজার ৫শত মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে,পানিবন্ধী হয়ে পড়েছিল প্রায় ২ হাজারে অধিক পরিবার। মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় কোন চেয়ারম্যান মেম্বারদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাত থেকে ৭ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় আপাতত ১৫ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য বিভাজন করে দেয়া হয়েছে। মোট ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ এখনো হিসাব করা যায়নি।
লামা পৌরসভার মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌর শহরের এমন কোন ব্যবসায়ী বা বাসিন্দা নাই যাদের বন্যা বা পাহাড় ধসে ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। দুর্গতের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে সহায়তায় সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতিশীঘ্রই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতা করা হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।
লামা উপজেলার অধিকাংশ সরকারি অফিস ভয়াবহ বন্যার পানিতে ডুবে ছিল লামা উপজেলা পরিষদ ভবন লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, লামা থানা, সহকারী পুলিশ সুপার কার্যালয়, লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কৃষি অফিস, প্রাণীসম্পদ অফিস, খাদ্য গুদাম, সমাজসেবা অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাচন অফিস, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, জেলা তথ্য অফিস লামা, বিআরডিবি অফিস, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, গণপূর্ত অফিস।
লামা উপজেলা প্রকৌশলী আবু হানিফ বলেন, টানা ৬-৭ দিনের বৃষ্টিতে ৪ দিনের স্থায়ী বন্যায় উপজেলার গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ একেবারে বিধস্ত হয়ে গেছে। কাঁচা পাকা রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। লামার বেশকিছু ব্রিজ- কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক ধারনা মতে অবকাঠোমোগত ক্ষতি অর্ধশত কোটি টাকার অধিক।
লামা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, বন্যার পানিতে লামা উপজেলার কমপক্ষে ২০টির অধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে গেছে বেশ ক্ষতি হয়েছে। মোট ক্ষয়ক্ষতির এখনো পরিমাপ করা যায়নি। এছাড়া লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সহ ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পানিতে ডুবে যায়।
লামা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মো. সেলিম হেলালী বলেন, বন্যায় লামা খাদ্য গুদামে সরকারি মজুদকৃত খাদ্য শস্যের মধ্যে ১৫০ মেট্রিক টন (৩ হাজার বস্তা) চাল পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। বান্দরবান জেলা কর্মকর্তার নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লামা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া চাল আলাদা করা হচ্ছে। বিষয়টি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে।
লামা বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেছে,অসংখ্য স্থানে গাছ পড়ে তাঁর ছিঁড়ে গেছে। লামা সাব স্টেশনে ইয়াংছা সহ কয়েকটি ফিড চালু করা হয়েছে।লামা পৌরসভা, রূপসীপাড়া, গজালিয়া, লামা সদর ও বমু বিলছড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করতে সময় লাগবে। আমাদের কর্মীরা বিরামহীন কাজ করে চলছে।
লামা উপজেলা কৃষি অফিসার রতন কুমার বর্মন বলেন,অধিকাংশ আবাদী জমি ও ফসলের মাঠ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সব ধরনের ফসল ও শাক-সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টির অবস্থা উন্নতি না হলে কৃষিখাত চরম বিপর্যস্থ হবে। প্রচুর মজুদ সার নষ্ট হয়ে গেছে।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, বন্যার শুরুতে ঝুঁকিতে থাকা লোক জনকে মাইকিং করে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হয়েছে। পরে তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পানিবন্ধী লোকজনকে দিনে-রাতে উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত ছিল। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে ৪ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সাধ্যমতে তাদের শুকনো ও রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। এখন ১৫ মেট্রিকটন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরো বরাদ্দ আসবে।
লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল বলেন, বন্যার পানিতে পানিবন্ধী মানুষকে নৌকায় করে জন প্রতিনিধিরা খাবার পৌঁছে দিয়েছে। অনেককে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। এতবড় বন্যার আঘাত ঘুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে। সরকারি সহায়তা বাড়ানো খুবই জরুরি। লামার বন্যার পরিস্থিতি নিয়ে পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এআরএস