অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম আর জীবনের সঙ্গে বাজি রেখে নানা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। নতুন বইয়ের গন্ধ নাকে আসলেও দৈন্যতার কারণে কেনা হয়ে ওঠেনি নতুন বই। তিন বেলা কোনো রকমে খেয়ে পড়ে দিনাতিপাত করাও ছিলো দুষ্কর। জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে ভাঙা ঘরে থাকা গরু ছাগলের সঙ্গে।
এতো প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও নিজের কাছে হেরে যাননি। ইচ্ছা ছিলো অধ্যায়ভিত্তিক পড়া-লেখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর। সেই ইচ্ছা শক্তি দীর্ঘ সময় পর চুড়ান্ত সাফল্যে পৌঁছে দিয়েছে জিয়াউর রহমানকে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুর দালালীপাড়া গ্রামের ছকিয়ত আলী ও জেলেখা বেগমের ছেলে জিয়াউর রহমান। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
তাঁর পিতা ছকিয়ত আলী গ্রামের প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। তিন শতকের বসতভিটা ছাড়া আর কোনো জমি নেই। সেই ছকিয়ত আলীও ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মহীন। মা জোলেখা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন।
অভাব আর সংকট নিত্যদিনের সঙ্গী হওয়ায় সংসারে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো। পড়া-লেখার কোনো পরিবেশ ছিল না এমনকি পড়ার টেবিল বলতে বাঁশের চাটাই। এভাবেই ২০১২ সালে নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পান তিনি।
জিয়াউর রহমান জানান, আলিমে ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখা হবে কি না তা নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সময় যাচ্ছিলো আমার। হাত খালি বই কিনবো কি দিয়ে এই চিন্তায় ঢাকায় চলে যাই বই-খাতা কেনার টাকা সংগ্রহ করতে। সেখানে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করি। কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে আসি, এসেই দেখি ছোট বোনের বিয়ের আয়োজন হয়ে গেছে। সেই জমানো টাকা বোনের বিয়েতে খরচ করে ফেলি, এরপর আর বই কেনা হয়নি।
স্বপ্ন বুনি নতুন করে, শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায় মুন্সীগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে যাই। সেখানেও কিছুদিন কাজ করে টাকা নিয়ে আসি সেই টাকা দিয়ে কিছু পুরাতন বই কিনে শুরু করি পড়ালেখা। পড়ালেখার ফাঁকে অন্যের জমিতে কাজ করি সংসারে সহযোগিতা করি। ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.৪৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।
তিনি আরো জানান, স্বপ্ন ছিলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করার। কিন্তু ভর্তি প্রস্তুতির বই কেনা ও কোচিং করার টাকা ছিল না। ওই সময় ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেই। সারাদিন ওষুধ কোম্পানির কাজ করে রাতে মেসে ফিরে ক্লান্ত শরির নিয়ে পড়ার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। তার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেই, কিন্তু উত্তীর্ণ হইনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পাই।
‘মিরপুর বাঙলা কলেজে` সুযোগ পেলেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারিনি। আবার কোচিং করার চিন্তা করি। কিন্তু চলার মতো হাতে টাকা নেই। সেই টাকার জন্য একটি সিকিউরিটি গার্ড কোম্পানিতে গার্ডের চাকরি নেই, পাশাপাশি ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হই। দুর্বার এক জীবন চাকরি-কোচিং একসঙ্গে চলে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
এরপর ভর্তি পরীক্ষা দেই রাজশাহী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম, নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে পথ চলন। কিভাবে কোথা থেকে পড়ালেখার খরচ আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাতখরচের টাকার জন্য পার্টটাইম কাজ করেন।
প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগে মেসে ওঠেন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুই বছর বৃত্তি পান। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে কখনো টিউশনি, আবার কখনো কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়া-লেখার খরচ জোগাড় করেন। নিজের জন্য জমা থাকে না কিছুই তবুও সেখান থেকে কিছু টাকা প্রতি মাসে বাবার চিকিৎসা ও মায়ের হাত খরচের জন্য বাড়িতে দিতে হতো। দীর্ঘ সময় জীবন অভাব-অনটন আর পারিবারিক অশান্তিতে কেটেছে তাঁর। এ কারণেই যেভাবেই হোক ভালো চাকরি পেতে হবে এই বাসনা আর স্বপ্ন নিয়ে চাকরির জন্য পড়া-লেখা করতে থাকেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৩.৪৬ ফলাফল লাভ করেন জিয়াউর রহমান। অ্যাপিয়ার্ড দিয়ে ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেন। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন, সেজন্যই প্রস্তুতি ভালোই ছিলো। কিন্তু মহামারী করোনায় সব কিছু বন্ধ হওয়ায় আবার আর্থিক সংকটে পড়েন। এ সময় বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে চলেন। তখন টাকার জন্য টাইলস ও রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজ করেন।
প্রিলিমিনারির সূচি প্রকাশের পর আবারও রাজশাহীতে চলে আসেন। ছাত্র হল না খোলায় কাছের এক বন্ধুর মেসে উঠে দুই মাস প্রস্তুতি নেন। পরে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। লিখিত পরীক্ষার জন্য কোচিং করার ইচ্ছা থাকলেও টাকার কারণে করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি বিসিএস কোচিংয়ে সামান্য টাকায় শুধু মডেল টেস্ট বা নমুনা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ভর্তি হন। প্রস্তুতি ভালোই ছিল, কিন্তু মানসিক অসুস্থতা এবং মাস্টার্স পরীক্ষা থাকায় লিখিত পরীক্ষা মোটামুটি হলেও যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে হয়ে ওঠেনি। তবুও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ভাইভা প্রস্তুতির জন্য বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোন বই পড়বেন, কিভাবে প্রস্তুতি নেবেন। তারপর সিনিয়রদের পরামর্শে ‘ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি’ বইটি সংগ্রহ করেন। শুধু এই একটি বই পড়েই তিনি ভাইভা দিয়েছেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটাও হয়। বিসিএস রেজাল্ট প্রকাশের দিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোলটি অন্তর্ভুক্ত দেখে জিয়াউরের চোখ দিয়ে এক অজানা সুখের জল চলে আসে যে তিনি এখন বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন।
ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, জিয়াউর এক অদম্য মানুষ, সে এখন আমাদের ইউনিয়নের অহংকার।
কামরুজ্জামান/এআরএস