বর্ষা আর শরতের সন্ধিক্ষণ মানেই গ্রাম বাঙলার বিল-ঝিলে পদ্ম ফুল ফোটার অপার সৌন্দর্যের হাতছানি। কালের রুদ্ররোষে হারিয়ে যেতে বসেছে পদ্মবিল। আর তাই প্রকৃতির অপরূপ অলঙ্কার কিশোরগঞ্জের পদ্মবিল দেখতে বিভিন্ন বয়সের সৌন্দর্যনুরাগী নারী-পুরুষের ঢল নেমেছে। পদ্মবিল হয়ে ওঠেছে হাওর পর্যটনের বাড়তি আকর্ষণ।
বন্ধু স্বজনদের নিয়ে ডিঙি নৌকায় উঠে দিগন্ত বিস্তৃত পদ্মবিলে পদ্ম ফুলের আভায় নিজেদের রাঙিয়ে নিতে ঘুরে বেড়ানোর মজাই যেনো ভিন্ন। আনমনে কখনও গুনগুন গান করে কিংবা কবিতা আবৃত্তি করে ক্ষণিকের জন্য নিজেদের আড়াল করে দেয়া হয় মনোমুগ্ধকর পরিবেশের চাদরে।
কবির ভাষায় উচ্চারিত হয় ‘মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর, তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো, সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!’ তিন প্রহরের বিলের সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়তো হয়নি কবির।
কিন্তু; চিরায়ত বাঙলার অপরূপ অলঙ্কার হিসাবে দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমিতে গোলাপি আভা ছড়িয়ে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সিংরইল বিল।
উপজেলার গুজাদিয়া ইউনিয়নের করাতি গ্রামের সিংরইল বিল প্রতি বর্ষা শেষে শরতকে আলিঙ্গন করে হাজারো গোলাপি পদ্মফুলের ঢালি সাজিয়ে। আর সেই অপরূপ-নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে এ পদ্মবিলে ভিড় করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বয়সের কৌতূহলী নারী-পুরুষ। এ যেনো কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাওর পর্যটনের আরও এক নতুন আকর্ষণ ও চমক।
প্রতি শুক্রবার ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনসহ প্রায় প্রতিদিনই পদ্মফুলের ডগায় ভ্রমর, পাখি ও সাপের খেলা কিংবা জলজ উদ্ভিদের মাখামাখি আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে সিংরইল পদ্মবিলে ভিড় করছেন প্রকৃতি প্রেমিক হাজারো নারী-পুরুষ।
সারি সারি ডিঙি নৌকা নিয়ে এ বিল পাড়ে অপেক্ষায় থাকেন মাঝিরা । এক শ্রেণির শিশু-কিশোররাই ডিঙি নৌকা নিয়ে পারাপার এবং বিল ঘুরে দেখানোর কাজ করে বাড়তি উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। বিস্তীর্ণ জলাভূমি নিয়ে গড়ে ওঠা এ পদ্মবিল কিশোরগঞ্জের হাওর পর্যটনের এক নতুন দুয়ারের উন্মোচন করেছে। পর্যটন শিল্পকে মহিমান্বিত করেছে।
জানা যায়, এক সময় ষড়ঋতুর নদীমাতৃক এ বাংলাদেশের গ্রাম বাঙলার বর্ষা ও শরতে অবারিত বিল-ঝিলে নানা প্রজাতির পদ্ম ও শাপলা ফুল শোভা পেত। তবে ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিক সভ্যতা, শিল্পায়ন এবং পরিবেশ সচেতনতার অভাবে আজকাল পদ্ম- শাপলা বিলের খুব একটা দেখা মিলে না। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে তো এমন পদ্মবিল দর্শন এক স্বর্গীয় আনন্দভূতির নাম।
শনিবার বিকালে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার করাতি গ্রামের সিংরইল পদ্মবিল সরেজমিন পরিদর্শন কালে ধরা পড়ে দেশের দূরদূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের প্রাণের কোলাহল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মূহুর্তে সিংরইল পদ্মবিল ঘুরে এক গুচ্ছ পদ্মফুল হাতে ছোট ভাইকে নিয়ে ডিঙি নৌকা থেকে নামছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গাজীপুরের মেয়ে নাজনীন সুলতানা। মুখোমুখি হতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ পদ্মবিল সম্পর্কে জানতে পেরে কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাইকে নিয়ে দেখতে এবং সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন বলে জানালেন। বললেন, পদ্মবিলটির বাস্তব অবস্থা এবং সৌন্দর্যে তারা অভিভূত। তাদের আগমন সার্থক।
এ সময় সিংরইল পদ্মবিল দেখতে একদল কচিকাঁচার সঙ্গে আসা মোহাম্মদ রফিক নামে ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’র কর্মীর সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তিনি পদ্মবিলের অস্তিত্ব ও সৌন্দর্য রক্ষায় ফুল তোলা ঠিক নয় বলে এ বিষয়ে স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করেন।
গণমাধ্যম কর্মী আশরাফুল ইসলাম তুষার বলেন, শ্বাশত ও চিরায়ত বাংলার অপরূপ অলঙ্কার এ পদ্মবিল আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না। সুতরাং; এসব পদ্মবিল রক্ষায় এখন নাগরিক সমাজের পাশাপাশি প্রশাসন ও সরকারের ভূমিকাও জরুরি।
শিক্ষক রঞ্জন কুমার সরকার জানালেন, সামনে (তাদের) সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। এ পূজায় ১০৮ টি পদ্ম ফুলের নৈবদ্য ছাড়া উৎসবের পূর্ণতা আশা করা যায় না।
পরিবেশ রক্ষা সামাজিক আন্দোলনের বিশিষ্টকর্মী জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক বললেন, বিল ঝিলের মতো প্রাকৃতিক জলাধার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যও খুব জরুরি। বর্ষা ও শরতে এসব বিল ঝিলে পদ্ম ও শাপলা ফুলের সমাহার প্রকৃতিকে মনোমুগ্ধকর করে তুলে। এইতো প্রকৃত অর্থে ষড়ঋতুর নদীমাতৃক দেশ বাঙলার চিরায়ত শ্বাশত রূপ।
করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কুমার বসু জানান, অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষ মানসিক প্রশান্তি ও বিনোদনের জন্য পদ্মবিলের আঁকেবাঁকে সবুজের সমারোহ ও সৌন্দর্য উপভোগ নির্বিঘ্ন করতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিলের প্রবেশ পথটি গতবছর সংস্কার করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে পদ্মাবিলটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আরও উপভোগ্য করতে সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এআরএস