বরিশাল নগরীর ২৩নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ সাগরদি খালের তীর ঘেঁষে চলে গেছে টিয়াখালী সড়ক। বর্ষায় খালটিতে সড়ক ছুঁই ছুঁই পানি থাকে। আবার শীত এলে পানি শুকিয়ে যায়। এই খালের পানি বড় কোনো খালে গিয়ে নামতে পারে না। ফলে বদ্ধ জলাশয়ের মতো আটকে থাকে পানি।
এতে মশার জন্মস্থান হিসেবে খুব উপযোগী বাস্তুসংস্থানে পরিণতি হয়েছে খালটি। শুধু মশার জন্মস্থান নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় নদর্মায় রূপ নিয়েছে খালটি। বর্ষায় যেমন পানিবাহিত রোগের ছড়াছড়ি থাকে এই এলাকার মানুষের তেমনি শুকনো মৌসুমে খালে আটকে থাকা ময়লা-আবর্জনার উৎকট গন্ধে ত্রাহি দশায় দিনাতিপাত করতে হয়।
এমন চিত্র শুধু বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৩নং ওয়ার্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, নগরীর মধ্য থেকে প্রবাহিত মৃতপ্রায় জেল খাল, ভাটার খাল, সাগরদী খাল, আমানতগঞ্জ খাল, লাকুটিয়া খাল, উত্তর সাগরদী খাল, নবগ্রাম খাল, নথুল্লাবাদ খাল, চাঁদমারী খাল, ভেদুরিয়া খাল, তাজকাটী খাল, শোলনা খাল, সাপানিয়া খাল, হরিনা ফুলিয়া খাল, চৌপাশা খাল, চর বদনা খাল, টিয়াখালী খাল, পশ্চিম হরিনাফুলিয়া খাল, কাটাখালী খাল, কৃষ্ণচূড়া খাল, ইছাকাঠী খাল, জাগুয়া খাল, নাপিতের খালেরও একই চিত্র। ফলে দুর্গন্ধ, মশার আক্রমণ আর পানিবাহিত রোগের উপদ্রবে নাজেহাল নগরীর এসব এলাকার বাসিন্দারা।

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন জানায়, ২০২০ সালে ২২টি খাল পুনরুদ্ধারে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা করা হয়েছিল। তবে সেই প্রকল্প পাস না হওয়ায় খালগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি নগর কর্তৃপক্ষ। যদিও তার চার বছর আগে ২০১৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসন স্বেচ্ছাশ্রমে জেল খাল পুনরুদ্ধারের জন্য নগরবাসীর সহায়তায় পরিচ্ছন্ন অভিযান পরিচালনা করেন।
এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে খাল খননের প্রক্রিয়া শুরু করা হলে সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এরপরে ২০২২ সালের মার্চ মাসে নগরীর সাতটি খালের (সাগরদী খাল, চাঁদমারী খাল, ভাটার খাল, জেল খাল, আমানতগঞ্জ খাল, পলাশপুর খাল ও রূপাতলী খাল) ১৮ কিলোমিটার পুনঃখননে ৭ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরে টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
তবে সেই প্রকল্পে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন আপত্তি জানানোয় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া থমকে যায়। দুটি দপ্তরের দূরত্বের কারণে উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল হয়ে যাওয়ায় নগরবাসীর ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরিশাল জেলার সমন্বয়ক রফিকুল আলম বলেন, একটি সুষম নগরীর জন্য ২০ শতাংশ ফ্লাড ফ্লো জোন থাকার কথা। কিন্তু বরিশালে তা রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ফ্লাড ফ্লো জোনের একটি বড় উৎস হচ্ছে নগরীর মধ্য থেকে প্রবাহিত খালগুলো। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বরিশালের মধ্য দিয়ে যাওয়া খালগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে। এতে নগরবাসী চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে সকল প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক জনগণ হলেও সরকার এর দেখভালকারী। সে অনুসারে জেলা প্রশাসন খালগুলো পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা নেবে। তবে সিটি কর্পোরেশন খালগুলোর সৌন্দর্যবর্ধন কাজের দায়িত্বে রয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকারের সমন্বয়ের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।তবে বরিশালের প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে বড় ধরনের একটি দূরত্ব রয়েছে।

রফিকুল আলম বলেন, খাল পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সিদ্ধান্তগুলো ছিল উদ্ভট। যে প্রকল্পটি পাঁচ টাকায় শুরু করা যায় সেটিতে তিনি প্রস্তাব করতেন ১০০ টাকা। ফলে যখন উপযোগিতা যাছাই করতে যেত তখন তা বাদ হয়ে যেত। একবার পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ কিলোমিটার খাল খননের টেন্ডার আহ্বান করলো। সিটি কর্পোরেশন তাতে বাধা দিলো। তখন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গে আমি কথা বলেছি।
তিনি বলেছেন, এই টাকায় খনন সম্ভব নয়। পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলেছিলাম কাজটি শুরু হোক। তিনি তাতেও রাজি হননি। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের দূরত্বের কারণে প্রকৃতপক্ষে নগরবাসী ক্ষতির মুখে।
ভাটারখাল এলাকার বাসিন্দা সাকিব বলেন, নগরীর সবগুলো ড্রেন এই খালের সঙ্গে যুক্ত। ফলে নোংরা আবর্জনা এই খাল থেকে কীর্তনখোলায় গিয়ে নামে। আমরা খালটির পাশের বস্তিতে থাকি। এখানে এত বেশি মশা আর দুর্গন্ধ থাকা সম্ভব না। তারপরও উপায় না থাকায় থাকতে হচ্ছে।
মড়কখোলা পোল এলাকার বাসিন্দা গনেশ শীল বলেন, জেল খালটি এখন পর্যন্ত বড় আকারের খালগুলোর মধ্যে একটি টিকে আছে। এই খালের দুই পাশের হাজার হাজার বাসিন্দা খালটির কারণে রোগে ভুগে কাবু হয়ে গেছি। তার ওপরে মশার উপদ্রবতো আছেই। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে মশার ওষুধ দেওয়ার কথা থাকলেও নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিন মাস ধরে মশার ওষুধও দিতে দেখছি না। ফলে খালপাড়ের বাসিন্দারা যে কি খারাপ পরিবেশে বাস করছি তা বলে বোঝানো যাবে না।
টিয়াখালী এলাকার বাসিন্দা হুমায়ূন কবির বলেন, আমাদের জন্য সিটি কর্পোরেশন বা জেলা প্রশাসন কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় না। খালগুলো ড্রেনে পরিণত হয়েছে। এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় নগরবাসী খুব বেহাল অবস্থায় রয়েছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসেবে নগরীর খালগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিষ্কার করা হয়। নগরীর মধ্য দিয়ে অনেকগুলো খাল বয়ে গেছে বিধায় এক সঙ্গে সব খাল পরিষ্কার করা সম্ভব না। তবে সর্বশেষ কবে খাল পরিষ্কার করা হয়েছে তা জানাতে পারেননি তিনি।
রেজাউল করিম বলেন, মেয়র পরিবর্তনের পর মশক নিধন অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে বিষয়টি তেমন নয়। আমরা ৩০টি ওয়ার্ডে দিন ভিত্তিক মশক নিধন অভিযান চালাই।
এআরএস