রাইসমিলের ছাইয়ে গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত

দিনাজপুর প্রতিনিধি প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪, ০২:৩৪ পিএম
রাইসমিলের ছাইয়ে গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত
ছবি: আমার সংবাদ

দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খাপখাওয়ানো উপযোগী তাপ, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু এবং রোগ-বালাই (গমের মরিচা রোগ, পাতা ঝলসানো ও ব্লাস্ট এবং ভুট্টার ফল আর্মিওয়ার্ম, ফিউজারিয়াম স্টকরট) প্রতিরোধী পুষ্টিমান সম্পন্ন গম ও ভুট্টার জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা ও প্রশিক্ষণে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

গম ও ভুট্টার পাশাপাশি সরগাম, ওট, বার্লি, ট্রিটিক্যালী ও ডুরাম গম নিয়েও প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে থাকে। নিজস্ব মাঠে সংকরায়ন এবং আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নয়ন কেন্দ্র, সিমিট’র সহায়তায় বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে গম ও ভুট্টাসহ উল্লিখিত ফসলসমূহের জাত ও প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে চারা গজানো থেকে ফসল পরিপক্কতা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ফসলের শারীরবৃত্তীয় বৃদ্ধি, খাদ্য গ্রহণ, সালোক সংশ্লেষণের হার, রোগবালাই এর প্রতি সহনশীলতা, ফলন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণের জন্য আলো, বাতাস, তাপমাত্রা ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় যা একমাত্র অনুকূল পরিবেশেই সম্ভব।

তবে গবেষণা মাঠের পাশেই অবস্থিত রাইস মিলের ছাই প্রতিনিয়ত গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের পাতা ও কান্ডের উপর পড়ে কালো আস্তরন তৈরী করছে। এতে চারা অবস্থা থেকেই গম ও ভুট্টার গাছ এক প্রকার প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ছে। বিজ্ঞানীদের মতে পাতায় অতিরিক্ত ছাই জমা হওয়ার কারণে পাতার সবুজ অংশ ঢেকে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এছাড়া প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ব্যহত হওয়ার কারণে শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণও কমে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়ন এবং শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। অন্যদিকে রাইস মিলের ছাই গাছের পাতার উপর পড়ার কারণে এক ধরণের স্থায়ী দাগের সৃষ্টি করছে যা গম ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের পাতার রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন গবেষণায় বাধা সৃষ্টি করছে। কারণ পাতার রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচনে রোগের কারণে সৃষ্ট দাগ ও ছাই এর কারণে সৃষ্ট দাগ এর মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।

গমের মরিচা রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এ রোগের জীবাণু গবেষণা মাঠে গমের পাতা থেকে সংগ্রহ করা। পাতায় ছাই’র আস্তরণের কারণে মরিচা রোগের জীবাণু সংগ্রহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সারা বছর নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগ প্রতিরোধী গমের জাত বাছাইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানে রয়েছে একটি গ্রিণহাউজ। পাশাপাশি ফল আর্মিওয়ার্ম প্রতিরোধী ভুট্টার জাত উন্নয়নে রয়েছে একটি ইনসেক্টেরিয়াম। রাইস মিলের ছাই গ্রিণহাউজ ও ইনসেক্টেরিয়াম’র স্বচ্ছ ছাদ ও দেয়ালে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে। ছাই’র আস্তরণের ফলে গ্রিণহাউজ ও ইনসেক্টেরিয়াম’র অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। গবেষকদের আশংকা এভাবে রাইস মিলের ছাই ফসলের উপর পড়তে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে মানসম্মত উচ্চ ফলনশীল রোগ প্রতিরোধী গম-ভুট্টার জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পরিবেশ সম্মত উপায়ে চালকল পরিচালনা করে মিলের ছাই উদগীরণ বন্ধ করা সম্ভব। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর গবেষণা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচলনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের হস্থ’ক্ষেপ প্রয়োজন।

এ বিষয়ে  প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহফুজুল হক বলেন, আমাদের এখানে অনেক মূল্যবান ভুট্টার জার্মপ্লাজম রয়েছে। ছাই পোড়ার দরুন গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে এবং গাছ প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করতে পারছেনা এবং ফিজিওলজিক্যাল গ্রোথ ঠিকমত হচ্ছে না।

গমের রোগ বালাই নিয়ে কাজ করেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কিশওয়ার-ই-মুস্তারিন  বলেন, ‘ছাই এসে গমের পাতার উপর এমন একটি স্তর তৈরি করছে যা ডিজিস ডাটা নিতে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। ছাইয়ের স্তরটা এমন ভাবে পাতাকে কাভার করছে, এটা ডিজিজ দ্বারা কতটুকু ক্ষতি বা ছাই দ্বারা কতটুকু ক্ষতি আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। সঠিক তথ্যটি পাচ্ছিনা। এতে করে গবেষণার কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।’

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ রেজাউল কবীর বলেন, ‘দেশীয় সংগ্রহ ও বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত মানের গম ও ভুট্টার জার্মপ্লাজম নিয়ে এসে গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন করা হয়। ইতোমধ্যে অনেক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাতায় ছাই পড়ার কারণে গবেষণা কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’

এদিকে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট’র মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলেন, সারা বিশ্ব থেকে জার্ম  প্লাজম এক্সচেঞ্জ করে থাকি। তিনি বলেন, ডিজিস স্কোরিং এর জন্য বিজ্ঞানীরা কনফিউজড হয়ে যাচ্ছেন। ফলে আমাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজ পুরোপুরি ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি দিনাজপুর জেলা প্রশাসক  এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এদিকে নশিপুর একতা রাইস মিলের কারণে দুই শতাধিক পরিবার অশান্তির মধ্যে রয়েছেন। কাপড়চোপড় খাদ্য সামগ্রীর উপর ছাই এসে পড়ে সব কিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে অভিযোগ করেও কোন ফল পায়নি নশিপুর গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার। তাদের চোখে ছাই পড়ে প্রায় সময় চোখের বিভিন্ন সমস্যা হয়।

অপরদিকে একতা রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মো. মোস্তফা ছাই পোড়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার রাইস মিল থেকে কোন ছাই বাহিরে যায় না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক গবেষক রুনায়েদ আমিন রেজা কে অফিসে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।

এআরএস