দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনের পাদদেশে অবস্থিত এই জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু মুন্ডারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে।
জানা যায়, ২২০ বছর আগে মুন্ডারা এসেছে ভারতের রাচি থেকে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৯ ইউনিয়নের কাশিপুর, গোপালপুর, ধুমঘাট, পাঁচশ বিঘা, ঈশ্বরীপুর, শ্রীফলকাটী, কদমতলা, কচুখালী, সাহেবখালী, শৈলখালী, ভেটখালী, তারানীপুর, কালিঞ্চী, বুড়িগোয়ালিনী, দাতনেখালী, কলবাড়ী, সোরা, পার্শেমারী গ্রামে ৪৫০ টি পরিবার নিয়ে মোট ২৫৫০ সংখ্যক এই সম্প্রদায়ের বসবাস।
একুশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসেও তারা সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরে।
আধুনিক সভ্যতার যুগেও আদিম জীবনে অভ্যস্ত এরা। কিছু কিছু মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা আধুনিকতার সামান্য ছোঁয়া পেলেও অধিকাংশই আধুনিকতা থেকে বঞ্চিত। অক্ষর, জ্ঞানহীন এবং অত্যন্ত সরল বিশ্বাসী হওয়ায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে এরা ৷
একটি বিশেষসূত্রে জানাগেছে যে, কোটা থাকলেও টাকার অভাবে চাকুরি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে ৷ গত ২০১৬ সালের একটি ঘটনা জানাগেছে, পুলিশ সদস্য পদ নিয়োগে ভেটখালী গ্রামের পঞ্চানন মুন্ডার মেয়ে বিথিকা মুন্ডা আবেদন করেছিলেন ৷ কিন্তু একটি ডিওলেটারের জন্য তার চাকরিটা জোটেনি ৷
বসবাসকারী মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা অনেকেই এখন নিঃস্ব। পাউবোর বেড়িবাঁধের ছোলপ মহাজনের পরিত্যক্ত জমি অথবা জনবসতি এলাকার যে কোন এক কোনায় এখন এদের মাথা গোজার ঠাঁই। জীবনের তাগিদে এরা বেছে নিয়েছে বিভিন্ন পেশা। কেউ অন্যের জমিতে দিন মজুরের কাজ করে, কেউ বনে জঙ্গলে মাছ ধরে, কেউ গৃহপালিত পশু পালন সহ বিভিন্ন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তবে এদের মধ্যে বেশির ভাগই শ্রমজীবী ৷
জীবন যুদ্ধ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। নিজের বলতে যা ছিল কালের বিবর্তনে তা বেহাত হয়ে গেছে।
মুন্ডারা সবাই গরীব। বনের গাছগাছালি সংগ্রহ করে দুইশ’ বছর আগে এ এলাকায় বসত ঘর তৈরি করে সামাজিক ভাবে বাস করছে। এক সময় তাদের অনেক জমিজমা ছিল, সচেতনতার অভাবে এলাকার প্রভাবশালী মহল তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে সব হাতিয়ে নিয়েছেন ৷
উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চী মৌজার ৪৭৪ দাগে ৩৫ বিঘা সম্পত্তি এখন ভূমিদস্যুদের দখলে, দাতনাখালীতে ১৪ বিঘা সহ একরকম অনেক জায়গায় ও এমন অবস্থা হয়ে আছে ৷ নিজ আদিভূমিতে তারা এখন অন্যের প্রজা। মুন্ডা পরিবারের নারী পুরুষ সবাই পরিবারের জীবিকার তাগিদে ঘরে বাইরে কাজ করে। তার পরেও দুঃখ দৈন্য তাদের ছেড়ে যেতে চায়না। মুন্ডা অভাবের সংসারে তাদের শিশুরা জন্মের পরেও দুঃখ কষ্টের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়। হাতে গোনা কিছু সংখ্যক শিশু ছাড়া অধিকাংশ শিশু শিক্ষা থেকে পিছিয়ে ৷ পিতা মাতার কষ্টের সংসারে তারাও সে কষ্টের ভাগ নেয় হাসিমুখে।
এলাকা ঘুরে তাদের জীবন সংগ্রামের এমন বাস্তব চিত্রটি পাওয়া গেছে ৷ শিশুরা বিদ্যালয়ে যায়না পরিবারের সহযোগিতা করা একমাত্র কাজ হিসাবে বেছে নিয়েছে । তাদের দাবি সরকারের একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মাথা গোজার ঠাঁই পেয়ে তারা অন্যদের মত জীবন যাপন করতে পারতো। এর অনেকে অনেক পরিশ্রমের কাজ করে থাকে।
জন্ম থেকে মুন্ডারা খুবই পরিশ্রমী, এরা বেকার ঘরে বসে থাকেনা। শ্রম বেঁচে তারা সংসার চালায়। তাও সঠিক পারিশ্রমিক তারা পায়না, তাই অভাব তাদের নিত্য সংঙ্গী। আবার অনেকে টাকার নোটের মান বোঝেনা। মহাজন খুশিমতো যাহা দেয় তাই নিয়ে নেয়। পারিশ্রমের মূল্য নিয়ে তাদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না।
মুন্ডারা মনে করে, জন্ম হয়েছে খেটে খাওয়ার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত খেটে খেয়ে যেতে হবে। মুন্ডাদের বাড়িতে টেলিভিশন নেই। খবরের কাগজ পড়ার আগ্রহ তাদের দেখা যায় না। খবরের কাগজের কথা জানতে চাইলে মুন্ডারা প্রায় চেনে না। অনেকে রেডিও শোনে। রাজনীতি তারা বোঝে না। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বরেরা তাদের সরকার। তারা মনে করে এরাই দেশ চালায়।
প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় মালিক পক্ষ অনেক বোকাঝোকা করে এমনকি অনেক নির্যাতনের শিকার হয়। এতকিছুতেই তাদের তেমন কোন দুঃখ নেই। জন্ম থেকেই পিতামাতার জীবন সংগ্রাম দেখে তারাও জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সীমিত গন্ডির মধ্যেই এরা ধীরে ধীরে বড় হয়েছে।
এদের মধ্যে অন্য সম্প্রদয়ের মানুষের মত কিছু সংউচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আশা রয়েছে ৷ তাদের কথা মুসলমান মেয়েদের পাশে বসলে তারা বৈষম্য মনে করে না। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের বংশীয় পরিবারের মেয়েরা তা মেনে নেয় না। তারা যেন অস্বস্তি বোধ করে।
মুন্ডাদের বড় দোষ তারা শুকুর পালে আর শুকুরের গোশত তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভক্ষণ করে থাকে। যে কারণে তাদেরকে একঘরে করে রাখা হয়। পদে পদে প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। এখনও কোনো প্রসূতি রোগীকে কোনো ক্লিনিকে বা হাসপাতালে ভর্তি করাতে সংকোচ বোধ করেন ৷
তাদের আরোগ্য লাভের মান্ধাতা আমলের ধারা এখনও পালন করতে হয়। তাই এ সম্প্রদায়ের মৃত্যুর হারও অনেক বেশি।
তাদের নিজস্বমতে সামাজিক অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। পৌষ মাসে "পৌষ সংক্রান্তি", চৌত্রে "সারুর উৎসব" ভাদ্র মাসে "করম পূজা" কার্তিক মাসে "সহরায়" সাংস্কৃতিক মেলা উদ্যাপন করে থাকে এই সম্প্রদায়। নিজেদের উদ্যোগে আর্থিক সমস্যার কারণে স্বল্পপরিহারে এই আয়োজন হয়ে থাকে ৷
বিয়ে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের নিজস্ব রেওয়াজে হয়ে থাকে। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে হয়। তাদের সম্প্রদায় ছাড়া বিয়ে হয় না। ভাষার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। যার নাম "সাদরী" ভাষা তারা ছাড়া কেহ সেই ভাষা বুঝতে পারেনা।
তবে তারা কঠিন অসুখে পড়লে বালাই তাড়াতে নিজস্ব দেবতার তুষ্ঠির আশায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে থাকে। এদের শিশুরা কারও সঙ্গ পায়না। তারা নিজেরাই নিজেদের সংঙ্গে খেলাধুলা করে থাকে। তাদের এলাকায় তেমন কোনো বিদ্যালয় নেই। ইতঃপূর্বে ঈশ্বরীপুর মিশনে খ্রিষ্টান ফাদার লুইজি পাজ্জি এখানে তাদের শিশুদের লেখা পড়ার জন্য ১২ টা কমিউনিটি স্কুলের ব্যবস্থা করছে। মুন্ডা সম্প্রদায়ের কোন লোক মারা গেলে মৃত দেহ গর্ত করে আতালির মাধ্যমে মাটি দেয়া হয়।
সম্প্রদায়ের গর্ত বিবিদের করাল গ্রাসে তারা এখন দিশেহারা। এমনকি তাদের জমি জায়গা পর্যন্ত বাজার দরে বিক্রি করতে পারেনা। সর্বনিম্ন দর আর একেবারে জনমফাকি দিয়ে মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকদের জমি নিয়ে থাকে সমাজের একশ্রেণীর অর্থলোভী মানুষ। তারা অন্যদের মত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।
সরকারের দেওয়া নানা সুবিধা তারা ভোগ করে থাকে। তাদের মধ্যে এখন অনেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। সমাজ সেবায় এগিয়ে এসেছে তারা। এদের মধ্যে শ্যামনগরে ৩ জন গ্রাম পুলিশের চাকুরি করছে।
এদিকে এদের অনেককেই হাঁড়িয়া মদের নেশার উপর থাকতে দেখা যায়। যা তৈরি কুচ, বুজ গাছের ছাল মিশ্রণ করে আতপ চাউলের গুড়া দিয়ে বড়ি তৈরি করা হয় ৷ ৩ কেজি চাউল ভাত রান্না করে ভাতের সাথে ৬ টা বড়ি মিশ্রণ করে একটি মেটে কলসে প্রায় ৪ দিন রাখার পর গরম পানি মিশিয়ে পান করে থাকে৷
পূর্ব পুরুষ থেকে এ নেশা জাতীয় পানি পান করাটাকে তারা ছাড়তে পারেনি। এটাকে তারা বংশগত রেওয়াজ বলে মনে করে।
এই নেশা জাতীয় পানি মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকেরা ইচ্ছা মত পান করে। আবার কোনো কোনো বিশেষ দিনে আবাল বৃদ্ধ বনিতা নেশা জাতীয় পানির নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠে। এমনকি নেশা জাতীয় পানি পান করে মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা স্বামী, সন্তান, ভাই-বোন ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে অনেকের শরীরে অবারণ খুলে গেলেও সেদিকে কারো খেয়াল থাকে না। এই নেশা জাতীয় পানির সাথে সুস্বাদু মসলা দিয়ে টাটকা ইঁদুরে গোশত (কিছুটা কাবাবের মত) করে রান্না করে খেয়ে থাকে। মুন্ডারা নেশা জাতীয় পানি তৈরির পদ্ধতি জানে। এই নেশা জাতীয় পানি তারা বিক্রি করে না। বাইরের কেউ পান করতে চাইলে খুশি মনে মুন্ডারা তাকে পান করিয়ে তৃপ্তি পায়।
খাবার পানি হিসেবে পুকুরের পানি ব্যবহার করে তারা। খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায় তাদের। বাল্যবিবাহ মুন্ডা সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশী প্রচলন। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারলে মেয়ের বাবা নিজেকে অপরাধী মনে করে। বিয়ের রাতে মেয়েকে বরের সাথে বাসর ঘরে দিয়ে মুন্ডারা আনন্দে মেতে উঠে। মুন্ডাদের প্রধান আকর্ষণ মুরগী পূজা। একটা পোষা মুরগী এক কোপে কেটে মুরগি রক্ত চার দিকে ছিটিয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করে। মুন্ডারা ভাল ভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেনা। কথা বলার বেলায় তাদের মধ্যে মিশ্র ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়। তাদের নিজেদের মধ্যে যখন কথা হয় সে ভাষা বাইরের কেউ বুঝতে পারেনা।
নেশা জাতীয় পানি না পানের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলার গোপালপুর রনজিৎ মুন্ডার পুত্র সত্যজিৎ বলেন, রক্তমাংসে মিশে যাওয়া এ নেশাটি খুব সহজে ছাড়া সম্ভব নয়। এটা আমাদের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। নেশা করাটা আমাদের বংশের ঐতিহ্য বলে মনে করা হয়।
শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চী গ্রামের মৃত বৈদ্য নাথ মুন্ডার পুত্র গোপাল বলেন, সমাজের শিক্ষিত মানুষ যদি ভালোভাবে তাদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করে এবং তাদের মাঝে সচেতনতা বোধ আনা যায় তবেই তা সম্ভব হবে।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ কলবাড়ী গ্রামের অখিল মুন্ডার পুত্র কৃষ্ণপদ মুন্ডা জানান, অভাব অনটনের সংসারে পিতামাতার সহযোগিতায় এত পরিশ্রমের কাজ করতে হয় ৷ শিশুদের চোখে মুখে যে কষ্টের ছাপ পড়ে আছে তার পরও করার কিছুই নেই। রোজগার করেই তাদের দু-মুঠো ভাত মুখে তুলে দিতে হবে।
বিআরইউ