নীল চাষের নির্মম ইতিহাস বিজড়িত হোসেনপুরের ঐতিহাসিক নীলকুঠি বাড়ির ধবংসাবশেষ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের চৌদার (সাহেবের গাঁও) এলাকায় নীলকরদের বাড়ি এবং টান সিদলা গ্রামে নীলকুঠির কার্যালয় ও পুরাতন পুকুরটি নীলকর সাহেবদের নানা স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে।
বাংলার তদানীন্তন সুলতান আলা উদ্দিন হোসেন শাহের নামানুসারে হোসেনপুর পরগনার ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে গড়ে উঠেছিল নীলকুঠি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নীলকুঠি প্রতিষ্ঠা করে নীলের আবাদ শুরু করে। এক সময় এখান থেকে ইংল্যান্ডে প্রচুর নীল রপ্তানি করা হতো। প্রথম দিকে ইংরেজরা নীলের ব্যবসায় লাভ করলেও পরে ব্যবসায় ধস নেমে আসে।
নীলকর ওয়াইজ স্টিফেন্স ছিলেন এর মালিক ও ব্যবসায়ী। প্রাচীন ঢাকার আরমানিটোলার আর্মানিয়ান ইংরেজ খ্রিষ্টান আর্মোনিয়ান আরাতুন দুই কন্যা ও তার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়েই হোসেনপুরে নীলকুঠির ব্যবসা চালু করেন। তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে বাধ্যতামূলকভাবে চাষিদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো নীল চাষ।
জানা যায়, ইংরেজ আমলে ফ্রান্সের অধিবাসী মাইকেল প্যাটেল হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের চৌদার (সাহেবের গাঁও) এলাকায় কারুকার্যময় একটি বাড়ি তৈরি এবং এলেনবেথ হেনসন জমিদার আমলে এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ করতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর এ বাড়িটি কিশোরগঞ্জ জেলার সাবেক সমবায় অফিসার মরহুম উম্মেদ আলী খরিদ সূত্রে মালিকানা লাভ করেন। বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর। বর্তমান বাড়িটি আমেনা মঞ্জিল হিসেবে পরিচিত। টান সিদলা বাবুর বাজার এলাকায় নীলকর কার্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ ও কার্যালয়ের পূর্ব দিকে সে আমলের একটি পুকুর রয়েছে। সে সময় এ অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে পানির সংকট থাকায় নীল চাষের সুবিধার্থে বিরাট পুকুর খনন করা হয়।
এলাকাটি আজও নীলের কুঠি হিসেবে পরিচিত। হোসেনপুরের সিদলা, পিতলগঞ্জ, হারেঞ্জা, চৌদার, রানী খামার, সাহেবেরচর এলাকায় আজও ইংরেজ পাদ্রী, পিতল বা পিতল সহ অন্যান্য খ্রিষ্টান নীলকরদের কিংবদন্তি কাহিনি এ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এবার নীল চাষের ইতিহাসের দিকে যাই। সবাই জানি, ১৭৫৭ সালে এই উপমহাদেশ ব্রিটিশরা তাদের কব্জায় নেয়। এর আগে ও পরে ইউরোপের অনেক দেশ থেকে বণিকরা এসে এদেশে ব্যবসা করতো। তাদের মধ্যে ফরাসি বণিকরাও ছিলেন। ১৭৭৭ সালে মঁসিয়ে লুই বোনার্ড নামের ফরাসি বণিক আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ এনে এ অঞ্চলে নীল চাষ শুরু করেন। তিনি হুগলি নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গায় সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। তাকে অনুসরণ করে ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম নামের এক ইংরেজ কুষ্টিয়ায় নীলকুঠি স্থাপন করেন। এর পর ১৭৭৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সবাইকে নীল চাষ করার আদেশ জারি করে। এভাবেই এ অঞ্চলে নীল চাষের সূচনা হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড়ে রঙের ব্যবহার বেড়ে যায়। তাতে নীলের চাহিদাও বহুগুণ বেড়ে যায়। সে সময় নীল চাষ এতই লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেক সরকারি আমলা-কর্মচারী এমনকি রাজনীতিক নিজ কাজ ভুলে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করেন। দেশীয় বহু জমিদার এবং মহাজনরাও ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে কারবার গড়ে তোলেন। এটা ছিল অনেকটা রাতারাতি ধনী হওয়ার মত কাহিনি। কিন্তু বিধি বাম! উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নানা কারণে সারা দুনিয়ার দৃশ্যপট বদলে যায়। সেসব কারণে নীল চাষের চেয়ে অন্যান্য খাদ্যশস্য, তেলবীজ ও পাট উৎপাদন বেশি লাভজনক হয়ে উঠে। কৃষকরা তখন নীলচাষের পরিবর্তে ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, তৎকালে এ অঞ্চলে প্রতিমণ নীল ৩০ টাকা দরে বিক্রি হতো। লন্ডনের বাজারে তা ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দামে রপ্তানি হতো। অথচ কৃষকদের দেয়া হতো মাত্র ৪ টাকা।
নীল ব্যবসায় নীলকরদের অনেক লাভ হতো সে কারণে নীলকর এবং তাদের দোসররা মিলে নানা অত্যাচার চালিয়ে নিরীহ কৃষকদের দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হতো। এভাবে নীল চাষের সঙ্গে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার কৃষককে জড়ানো হয়। ১৮৫৯ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নীলচাষীরা সংঘবদ্ধভাবে নীলচাষ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নীল চাষ আইন বাতিল ও নীলকরদের নির্মম নিপীড়নের প্রতিবাদে যশোর অঞ্চলের কৃষকরা বিদ্রোহ শুরু করে।
বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম যশোর জেলার চৌগাছায় (পূর্বতন নদীয়া) এ বিদ্রোহ দেখা দেয়। তা ক্রমশ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় নীল চাষের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ লাখ কৃষক প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তাদের বিদ্রোহে বাংলার প্রধান ধর্মীয় নেতাও সমর্থন দেন। যাদের মধ্যে চাঁদপুরের ধর্মীয় নেতা হাজি মোল্লা ছিলেন অন্যতম। সে সময় হাজি মোল্লা বলেছিলেন যে, নীল চাষের চেয়ে ভিক্ষা উত্তম।
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তদন্ত করে চাষীদের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায়। নীলচাষীদের উপর নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে কমিশনের কাছে সে সময় ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ‘ডেলাতুর’ বলেছিলেন যে, এমন একটা নীলের বাক্স ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়। ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। পরে ক্রমে ক্রমে নীলের উৎপাদন কমে যায়। অতঃপর নীলকররা নীল চাষে সুবিধা করতে না পেরে ১৮৯৫ সালের দিকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ১৯০০ সালের মধ্যে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণরূপে নীলচাষের অবসান হয়।
অন্যান্য পণ্যের মত নীলচাষও এদেশে জনপ্রিয় হতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য নীলকর এবং তাদের দোসরদের পাকিস্তানি হানাদারদের মত আচরণের কারণে নীল চাষ তখন এ অঞ্চল থেকে বিদায় নেয়। আসলে নীলচাষ তখন অলাভজনক ছিল না। প্রকৃতপক্ষে নীলচাষীরা তখন নীলচাষের বিনিময়ে উপযুক্ত দাম পেতেন না। আবার এনিয়ে নীলকরদের নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাদের। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, যে দেশের মানুষ এখনও তামাক চাষ ছাড়তে পারেন নি সে দেশে নীল চাষ বিতাড়িত হওয়ার কথা ছিল না। তাই তো আবারো নীল চাষের দিকে ঝুঁকছে এদেশের মানুষ। ইতোমধ্যে দিনাজপুরে এবং রংপুরের দুই তিনটি উপজেলার প্রায় ১০টি ইউনিয়নে সীমিত পরিসরে নীলের চাষ শুরু হয়েছে। গড়ে উঠেছে ছোটখাটো কারখানাও। সেই নীল দিয়ে রাঙিয়ে ব্যাগ, ফতুয়া, চাদর, নকশীকাঁথা ও বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। দেশবিদেশে এসব পণ্যের প্রচুর চাহিদাও রয়েছে। দিনাজপুর এবং রংপুরের নীলচাষীদের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে যে, এখন যেহেতু ব্রিটিশ নীলকরদের উৎপাত নেই সেহেতু নীলচাষ আবারও এদেশে ফিরে আসুক তা তারা চান।
নীল গাছ দেখতে অনেকটা ঝোপ গাছের মত। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা হয়। জীবনকাল ৬ মাস। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ বপন করলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গাছ মারা যায়। গাছের পাতা সবুজ কিন্তু যে ফুল হয় তা প্রথমে গোলাপি ও পরে বেগুনি রঙের হয়। তবে কিছু কিছু জাতের ফুল সাদা ও হলুদ রংয়েরও হয়। ফল ও বীজ সরিষার মতো। মাষ কলাইয়ের মত এক চাষ দিয়েই বীজ বপন করা যায়। বীজ বপনের তিন মাস পর গাছের পাতা কাটা যায়। ছয় মাসের মধ্যে ৪-৫ বার পাতা কাটা যায়। পাট গাছের মত নীল গাছকেও পানিতে জাগ দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নীল রং তৈরি করা হয়।
নীল কিন্তু শুধু রং হিসেবেই নয়, নানাক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। সুতি বা উলেন সিল্ক কাপড়ের রং উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে এর জুড়ি নাই। পাট গাছের মত নীল গাছ উৎকৃষ্ট জ্বালানি ও জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নীল থেকে তেলও হয়। জামা-কাপড় ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা এবং শরীর এলার্জিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রেও নীলের ভূমিকা আছে। নীল ব্যবহারে গায়ের চামড়াও ভাল থাকে। কলপ, নীলের খৈল থেকে লোশন, সেভিং ফোম ইত্যাদিও তৈরি হয়। ভেষজ গুণ থাকায় চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নানা অসুখে নীল গাছ ব্যবহার হয়।
ইএইচ